দাওয়াই: বিনা কারণে লকডাউন ভেঙে রাস্তায় বেরোনোয় হাওড়ার সালকিয়ায় মার পুলিশের। শনিবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
শনিবার সকাল ১০টা। উত্তর হাওড়ার সালকিয়ার কাছে বাবুডাঙা মোড়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা অনুযায়ী, করোনার ‘রেড স্টার জ়োন’।
লকডাউনের বিধি-নিষেধের পরোয়া না-করে প্রতিদিনের মতো এ দিনও বাজারে যাওয়ার অছিলায় সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন
এক যুবক। পুলিশের ভয়ে সঙ্গে ছিল বাজার করার একটি থলে। ওই যুবক আসলে যাচ্ছিলেন পাশের পাড়ায়, বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিতে। অন্য দিন পার পেয়ে গেলেও এ দিন তা হল না। পুলিশের প্রশ্নের মুখে পড়ে সত্যি
কথাটা বলতেই পায়ে-পিঠে পড়তে শুরু করল লাঠি। কিছু ক্ষণ মারধরের পরে ওই যুবককে কান ধরে টেনে ভ্যানে তুলল পুলিশ।
বেলা ১২টা। ‘রেড স্টার’ হিসেবে চিহ্নিত শিবপুরের চওড়া বস্তির মোড়। বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে জিটি রোডে বেরোনোর রাস্তা। সেই ব্যারিকেড গলে জিটি রোডে চলে এসেছিলেন চার যুবক। রাস্তা দিয়ে ওই সময়ে আসছিল র্যাফের একটি গাড়ি। ওই যুবকদের দেখতে পেয়েই গাড়ি থেকে নেমে লাঠি নিয়ে তাড়া করেন র্যাফের জওয়ানরা। কোনও মতে ব্যারিকেড গলে পালিয়ে যান তিন জন। ধরা পড়ে যান এক যুবক। শেষে তাঁকে লাঠিপেটা করে ফের ব্যারিকেডের ওপারে পাঠিয়ে দেয় র্যাফ।
শুধু সালকিয়া বা শিবপুর নয়। ‘রেড স্টার জ়োন’ হিসেবে চিহ্নিত হাওড়া ময়দান চত্বর, মল্লিকফটক, শিবপুর, ট্রাম ডিপো— বেলা ১২টা পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল এক চিত্র।
লকডাউন না-মানায় শেষে বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হয় পুলিশ। ব্যাঙ্কের পাসবই, টেলিফোন বিল বা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে অহেতুক রাস্তায় ঘুরতে বেরোনো মানুষকে হয় লাঠি নিয়ে তাড়া করতে হয়েছে, নয়তো লাঠিপেটা করে গ্রেফতার করতে হয়েছে। অনেককে আবার বলা হয় বাড়ি ফিরে যেতে। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে গাড়ি, মোটরবাইক থামিয়ে চলেছে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি।
হাওড়ার পুলিশ কমিশনার কুণাল আগরওয়াল বলেন, ‘‘শনিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ‘ন্যাশনাল ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৫’ অনুযায়ী লকডাউন ভাঙার জন্য ৩৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়াও, ১৫টি গাড়ি, একটি অটো ও ৭০টি মোটরবাইক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।’’
তবে সকাল থেকে পুলিশের মারমুখী ভূমিকা ও ধরপাকড়ের ভয়ে অন্য দিনের তুলনায় হাওড়ার বড় রাস্তাগুলিতে মানুষের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট কম। বাজার-দোকানেও ভিড় খুব একটা হয়নি।
কিন্তু এ দিনই আবার ‘রেড স্টার’ হিসেবে চিহ্নিত টিকিয়াপাড়ার বেলিলিয়াস রোডে দেখা গিয়েছে অন্য ছবি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজন গল্পগুজব করছেন। দোকানগুলির সামনেও প্রচুর ভিড়। অথচ, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশের টহলদারি ভ্যান। তার সামনেই একটি ব্যাঙ্কের বাইরে দূরত্ব-বিধি না মেনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে লাইনে দাঁড়িয়ে শতাধিক মানুষ।
এ ভাবে লাইনে দাঁড়িয়েছেন কেন?
সইদুল আলি নামে এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর জনধন অ্যাকাউন্টে ৫০০ টাকা করে পাব বলে আমরা লাইন দিয়েছি। শুনেছি, আজকেই শেষ দিন। করোনাকে ভয় না পেয়ে সবাই মিলে লাইন দিয়েছি।’’
অন্য দিকে, কদমতলা বাজার বা কালীবাবুর বাজারের মতো জায়গায় পুলিশ ব্যারিকেড করে লোকজনকে একসঙ্গে ঢুকতে না দেওয়ায় বাজারের ভিতরে ভিড় হয়নি। মাস্ক না পরে কেউ এলে তাঁকে যেমন বাজারের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি পুলিশ, তেমনই বাজারে ঢোকার আগে সকলের হাত স্যানিটাইজ়ার দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে। শিবপুর বাজারে ভিড় বেশি হওয়ায় ওই বাজার বন্ধ করে সিকি মাইল দূরের ধোপার মাঠে তা স্থানান্তরিত করেছে পুলিশ।
হাওড়া পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের করোনাপ্রবণ এলাকাগুলি আগেই ‘সিল’ করে দিয়েছিল পুলিশ। শুক্রবার আরও কয়েকটি রাস্তা ও জিটি রোড সংলগ্ন কিছু গলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল থেকেই হুটার বাজিয়ে নেমে পড়ে পুলিশের বিশেষ বাইকবাহিনী। দিনভর বিভিন্ন রাস্তায় টহল দেন সিটি পুলিশের পদস্থ কর্তারা। তবে বেলা ১২টার পর থেকে ধীরে ধীরে সামগ্রিক লকডাউনের চেহারা নেয় গোটা হাওড়া শহর।
হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন পুলিশ কমিশনারের অফিসে জেলাশাসক ও হাওড়া পুর কমিশনারের সঙ্গে বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়। বৈঠকে ঠিক হয়েছে, হাওড়া শহরের ন’টি বাজারের ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব নেবে ওই সংগঠনগুলি। তাঁদের স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক ও গ্লাভস দেওয়ার পাশাপাশি খাবারও দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে বাজার কমিটিগুলির সঙ্গে আজ, রবিবার ফের বৈঠক হবে।
এ দিন স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে পরিদর্শনে যান এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জ্ঞানবন্ত সিংহ।