Coronavirus in Howrah-Hoogly

জঙ্গলমহল থেকে ফকিরকে লড়াইয়ের মন্ত্র বাবা-মা’র

কোভিড আতঙ্কে হুগলির শ্রীরামপুর থেকে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন বাঁকুড়ার সিমলাপালের লাদনা গ্রামের বছর উনিশের ফকির মাঝি।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২০ ০৬:০২
Share:

ফকির এবং তার বাবা-মা। —নিজস্ব িচত্র

মাসখানেক আগে ফোনে ছেলের আতঙ্কের কথা শুনে সাহস জুগিয়েছিলেন নিরক্ষর বাবা-মা। বলেছিলেন, ‘‘শোন বাপ, এখন এখানে আসিস না। এখন তুকে হাসপাতালে দরকার বটে। ভয় পাস না বাপ। লড়ে যা।’’

Advertisement

কোভিড আতঙ্কে হুগলির শ্রীরামপুর থেকে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন বাঁকুড়ার সিমলাপালের লাদনা গ্রামের বছর উনিশের ফকির মাঝি। যে হাসপাতালে তিনি নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন, সেই শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসাকেন্দ্র করা হয়েছে। ভয় করবে না!

বাবা হাবু মাঝি এবং মা মেনকাকে সে কথাই বলেছিলেন ফকির। তাঁদের কথায় সাহস পেয়ে সিদ্ধান্ত বদল করেন তিনি। এই সঙ্কটের সময়ে হাসপাতালেই কাজ করবেন। বাড়ি ফিরবে‌ন না। ফকির বলেন, ‘‘আমি বাড়ি ফিরব শুনে বাবা বলল, ভয় পেলে হবে না। এখন হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। মা-ও একই কথা বলল। ভয় কোথায় হারিয়ে গেল!’’

Advertisement

ছেলের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে তৃপ্ত হাবু-মেনকাও। ফোনে জানান, ভাইরাসকে হারাতে হলে মানুষের সেবা করা জরুরি। ছেলে হাসপাতালের কাজে লাগছে বলে তাঁদের ভাল লাগছে। ফকির তাঁদের একমাত্র ছেলে। পাঁচ মেয়ে রয়েছে। তাঁদের মধ্যে চার জনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। হাবুর জমি-জিরেত নেই। তিনি ভ্যান চালান। মেনকা ডাক পেলে খেতমজুরি করেন। ছে‌লেবেলায় ফকির স্কুলে ভর্তি হলেও পড়াশোনা তেমন করতেন না। বাবার সঙ্গে ভ্যানে চেপে এখানে-ওখানে যাওয়াই ছিল তাঁর রোজনামচা। বছর নয়েক আগে সে এবং দিদি জ্যোৎস্না শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতালে চলে আসেন। এখানে পড়াশোনা শেখেন। ফকির এখন বালির শান্তিরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। কয়েক মাস ধরে শ্রমজীবী হাসপাতালে স্বাস্থ্য সহায়কের কাজের প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন। সেই বাবদ বৃত্তির কিছু টাকা পান। জ্যোৎস্নাও একই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

বর্তমানে শ্রমজীবী কোভিড-১৯ হাসপাতালে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ফকির। গেট খোলা-বন্ধের পাশাপাশি করোনা সন্দেহে কোনও রোগী এলে অ্যাম্বুল্যান্সকে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড় করিয়ে ওয়ার্ডে খবর দেওয়া, রোগীর আত্মীয়-স্বজনের দিকে খেয়াল রাখা— সবই করছেন হাসিমুখে।

হাবু জানান, এখন বাড়িতে তিনি আর স্ত্রী। লকডাউনের জন্য কাজ বন্ধ। কোনও রকমে দু’জনের চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা পড়াশোনা শিখিনি। কিন্তু এটুকু বুঝি, ওই হাসপাতালে আমাদের ফকির ছোট থেকে বড় হয়েছে। ওখানে ভালই আছে। ভাল সময়ে থাকবে আর প্রয়োজনের সময়ে গ্রামে ফিরে আসবে, এটা ঠিক হত না। তা ছাড়া মানুষের সেবার কাজ শিখতেই তো ছেলেকে ওখানে পাঠিয়েছি। সাবধানে থাকলে কোনও ক্ষতি হবে না।’’

ওই দম্পতির এই মানসিকতাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন হাসপাতালের সহ-সম্পাদক গৌতম সরকার। তিনি বলেন, ‘‘ওঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরও শক্তি জুগিয়েছে।’’ হাসপাতালের সম্পাদক চিকিৎসক অনিল সাহার কথায়, ‘‘আমরা রোগী দেখছি। তবে ফকিরদের ভূমিকাও বড় কম নয়। সবাই মিলেই এই অসুখের মোকাবিলা করতে হবে। ফকিরের বাবা-মা এই সারসত্যটা অনুধাবন করেছেন। নিজেদের ছেলেকে যে ভাবে ওঁরা উজ্জীবিত করেছেন, এটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।’’

‘ডিউটি’ শেষে মোবাইলে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেন ফকির। লাল মাটির প্রান্তর থেকে ছেলেকে লড়াইয়ের মন্ত্র শোনান বাবা-মা।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement