বছর কয়েক আগে মেয়েদের রঙিন পোশাক কিংবা মোবাইল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল উত্তরপ্রদেশের মাতব্বরেরা। এ বার মেয়েরা কোন পার্লারে যাবে, কোথায় যাবে না সেই বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠল খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে। ঘটনাস্থল গো-বলয় নয়, হুগলির আরামবাগ।
আরামাবাগ থানা এলাকার মধ্যে ২৫টি পার্লার রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৫টি শুধুমাত্র মেয়েদের। বাকিগুলি ইউনিসেক্স (ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য) পার্লার। সেগুলিতে শুধু পুরুষ কর্মীরাই কাজ করেন। রবিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তেমনই ১৩টি পার্লারে অভিযান চালিয়েছে আরামবাগ মহিলা থানা। কোনও পার্লারে ঢুকে সদ্য ব্লিচ করা মহিলাকে মুখ ধুয়ে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছে। কোনও পার্লারে গিয়ে সোজাসুজি বলা হয়েছে, ‘‘ছেলেদের হাতে ফেসিয়াল করা চলবে না।’’ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুর্ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। অনেকেই ভেবেছিলেন, কোনও অভিযোগ পেয়ে অথবা কোনও প্রমাণ হাতে নিয়েই এই অভিযান। কিন্তু পুলিশের বিভিন্ন স্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, কোনও পার্লারের বিরুদ্ধেই কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না।
তাহলে কেন এই অভিযান? আরামবাগ মহিলা থানার ওসি ঝর্ণা দাসের সাফাই, “নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না ঠিকই। তবে ভবিষ্যতে যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেই লক্ষ্যেই অভিযান চালিয়ে পার্লারগুলিকে সতর্ক করা হয়েছে।” তিনি বলেন, “নির্মল বাংলা গড়তে মুখ্যমন্ত্রী উদ্যোগী হয়েছেন। আমরা সেই লক্ষ্যেই ইউনিসেক্স পার্লারগুলি বন্ধ করতে চাই। আমরা প্রতি মাসেই নিয়ম করে অভিযান চালাব।”
কিন্তু কে কোন পার্লারে যাবে সেটি ঠিক করা কি পুলিশের কাজ? ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পরে উঠেছে এই প্রশ্ন। আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি পার্লারের মালিক শেখ আসিফ ইকবালের দাবি, “পুরসভা থেকে পার্লারের জন্য বৈধ অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করছি। এসব জুলুম ছাড়া কিছুই নয়।” এলাকার আর এক পার্লার ব্যবসায়ী সুপ্রিয় দত্তের কটাক্ষ, ‘‘আরামবাগ মহিলা থানার বক্তব্য মানলে তো মহিলারা পুরুষ দোকানদারের থেকে শাঁখা-পলা কিনতে পারবেন না। পুরুষ দর্জি কোনও মহিলার পোশাকের মাপ নিতে পারবে না। স্ত্রী বিশেষজ্ঞ পুরুষ চিকিৎসকদের কাছেও যেতে পারবেন না মহিলারা!’’
অভিযান চলার সময়ে একটি পার্লারে ছিলেন আরামবাগ সতীতলার এক কলেজ ছাত্রী। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘আমি কোন পার্লারে যাব, সেটি আমার ব্যক্তিগত বিষয়। সেটি ঠিক করা পুলিশের কাজ নয়।’’ স্থানীয় নওপাড়ার এক তরুণীর অভিযোগ, ‘‘পুরুষের হাতে কেন ব্লিচ করাচ্ছো এই প্রশ্ন করেই আমার ভিডিও করতে শুরু করে একজন মহিলা পুলিশ। আমি প্রতিবাদ করায় থানায় তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বাড়িতে ফোন করতেও দেওয়া হয়নি।’’
তৃণমূলের আরামবাগ ব্লক কার্যকরী সভাপতি আব্দুল সেলিম বলেন, ‘‘পুলিশের এই অযাচিত খবরদারি মোটেও একদম ঠিক নয়। বিষয়টি এসডিপিওকে জানাবো।” কালীপুর কলেজের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীর কথায়, “ঠিক খরচে যেখানে ভাল পরিষেবা পাব সেখানেই যাব। বাইরের রাজ্যে নীতি পুলিশের কথা শুনেছি। চোখের সামনে দেখতে পাব কোনও দিন ভাবিনি।’’
তবে মহিলাদের দিয়েই মহিলাদের পরিষেবা দেওয়ার পক্ষে অনেকেই। বেঙ্গাই হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা শুভা মুখোপাধ্যায় বলেন, “পেশাদার পার্লারগুলির ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নেই। তবে সাধারণ পার্লারগুলিতে অঘটন রুখতে মেয়েদের কাজ মেয়েদের দিয়ে করাতে পারলেই ভাল।” শুভাদেবীর মতকে সমর্থন করেছেন আরামবাগের শিক্ষাবিদ প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়, ব্যবসায়ী নয়ন তরফদার, গৃহবধূ রঞ্জনা ঘোষের মতো কয়েকজন। তবে একই সঙ্গে পুলিশের অভিযোগ ছাড়া পার্লার-অভিযানকে তাঁরা অবশ্য কেউই সমর্থন করেননি।
কী বলছে পুলিশের উপরমহল? হুগলির (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার সুকেশ কুমার জৈন বলেন, “কিসের অভিযান, কেন অভিযান, বিষয়টি আমি বুঝতে পারছি না। যা বলার এসডিপিও বলবেন।” আরামবাগের এসডিপিও হরেকৃষ্ণ পাই বলেন, “পার্লার সংক্রান্ত নিয়ম খতিয়ে না দেখে কোনও মন্তব্য করব না।”