কাটমানি: পারদ চড়ছে হুগলিতে

সদস্য এবং তাঁর স্বামী তথা দলের বুথ সভাপতি বাবর আলি খাঁ-সহ তাঁর দুই মেয়েকে রাস্তায় ফেলে কিল-চড় মারার অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৯ ০১:৪৭
Share:

গৌরহাটি-১ পঞ্চায়েতে বিক্ষোভ। নিজস্ব চিত্র

দুর্নীতি এবং কাটমানি ফেরতের দাবি তুলে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সদস্যদের বাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে আরামবাগ মহকুমায়। মঙ্গলবার সকালে আরামবাগের গৌরহাটি-১ পঞ্চায়েতের সদস্য বেউর গ্রামের রহিলা বেগমের বাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভের অভিযোগ উঠল স্থানীয় গ্রামবাসী এবং বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে।

Advertisement

সদস্য এবং তাঁর স্বামী তথা দলের বুথ সভাপতি বাবর আলি খাঁ-সহ তাঁর দুই মেয়েকে রাস্তায় ফেলে কিল-চড় মারার অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গ্রামবাসী এবং বিজেপি কর্মীরা। ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। পুলিশ জানায়, সরকারি প্রকল্প নিয়ে কোন অভিযোগ থাকলে তা ব্লক প্রশাসনের কাছে জানাতে বলা হয়েছে বিক্ষোভকারীদের।

গত ২০১৩ সাল থেকে পঞ্চায়েত সদস্য হিসেবে রয়েছেন বাবরের স্ত্রী রহিলা। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, ‘‘গ্রামোন্নয়নের নামে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বাবর লক্ষ লক্ষ টাকার দুর্নীতি আর কাটমানি খেয়েছে। গ্রামে কোনও উন্নয়ন হয়নি। এমনকি পারিবারিক বিষয়ে তার মীমাংসা না মানলে বা দাবি মতো টাকা না দিলে মারধরও করেছে সে।’’

Advertisement

চন্দননগর পুরসভায় বিক্ষোভ। নিজস্ব চিত্র

ওই গ্রামেরই বাসিন্দা প্রাক্তন তৃণমূল নেতা বর্তমানে বিজেপির বুথ সভাপতি নজরুল ইসলামের অভিযোগ, “সম্প্রতি পঞ্চায়েত থেকে হিসাব নিয়ে জানতে পেরেছি, বেউর গ্রামের ৮ নম্বর সংসদে ৮০ লক্ষ টাকার ১০০ দিনের কাজ হয়েছে খাতায় কলমে। কিন্তু কবরস্থানে কিছু ঘাস পরিষ্কার করা ছাড়া কোথাও কোন কাজ চোখে দেখা যায়না। পুরো টাকাই ভুয়ো মাস্টাররোল বানিয়ে তুলে নিয়েছে বাবর। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা এবং গীতাঞ্জলি (আবাস) প্রকল্পের উপভোক্তাদের কাছে ২২ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছে। ওইসব মানুষরা বিডিওর কাছে অভিযোগও জানাবেন।”

দুর্নীতি এবং কাটমানি নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সদস্য রহিলা বিবি খাঁ এবং তাঁর স্বামী বাবর আলি খাঁ। বাবর বলেন, “আমি বিক্ষোভকারীদের বলেছিলাম, যদি এক টাকাও কারও থেকে নিয়েছি বা কোনও সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি করেছি বলে প্রমাণ করতে পার, তাহলে আমি তার ১০ গুণ টাকা জরিমান দিতে রাজি আছি। তারপরেও আমাদের সবাইকে রাস্তায় টেনে এনে মারা হল”।

বাবরের অভিযোগের তির আক্তার আলি শা নামে এক গ্রামবাসীর দিকে। তাঁর অভিযোগ, আক্তারের প্ররোচনাতেই তাঁদের মারধর করা হয়। বাবরের অভিযোগ, ‘‘আক্তারের আটটা বিয়ে রয়েছে। আবার ও কয়েকদিন আগে আর একটা বিয়ে করেছে। তারই প্রতিবাদ করায় গ্রামবাসীদের ভুল বুঝিয়ে এই হামলা করিয়েছে।”

বাবর বিকেলে আক্তার আলি শা, সরিফুল শা, হাসিবুল শা এবং সাহেব শা নামে চারজন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ জানায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযুক্ত আক্তার আলি শা বলেন, “নিজের দুর্নীতি ঢাকতেই বাবর মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছে। ’’

বিষয়টা নিয়ে আরামবাগ তৃণমূল ব্লক সভাপতি স্বপন নন্দী বলেন, “মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিজেপি আমাদের নেতা-কর্মীদের মারধর করছে। এ সব অন্যায়ের প্রতিবাদ সাধারণ মানুষই করবেন।” অন্য দিকে বিজেপির আরামবাগ জেলা সভাপতি বিমান ঘোষ বলেন, “দীর্ঘদিন দুর্নীতি এবং জুলুমবাজির প্রতিবাদ করছেন গ্রামের মানুষ। আমরা সঙ্গে আছি। কাটমানি নিয়ে প্রতিবাদে কোথাও কোন মারধরের ঘটনা ঘটেনি।”

এ দিন দুপুরে গোঘাটের হাজিপুর পঞ্চায়েতেও কাটমানি ফেরত, দুর্নীতি -সহ মোট ১৯ দফা দাবিতে প্রধানের কাছে স্মারকলিপি দেয় বিজেপি।

বিক্ষোভ চন্দননগর পুরসভার সামনেও

তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলরদের দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং ‘কাটমানি’ ফেরতের দাবিতে মঙ্গলবার দুপুরে চন্দননগর পুরভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখাল বিজেপি।

এই পুরসভায় আসন ৩৩টি। তৃণমূলের হাতে ছিল ২৩টি আসন। তৃণমূল কাউন্সিলরদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে কয়েক মাস আগে পুরবোর্ড ভেঙে দিয়েছে রাজ্য সরকার। পুরসভা চালাচ্ছে সরকার নিযুক্ত কমিটি। বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, শাসক দলের অধিকাংশ কাউন্সিলরই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা নিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছেন।

এ দিন বেলা আড়াইটে নাগাদ বিজেপির নেতা-কর্মীরা পুরসভার গেটের বাইরে বিক্ষোভ শুরু করেন। অভিযোগ তোলা হয়, তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলররা বিভিন্ন প্রকল্পে ‘কাটমানি’ নিয়েছেন। পরিষেবা দিতে সাধারণ মানুষের থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। সেই টাকা ফেরত এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তির দাবি জানানো হয়। পুর-কমিশনার স্বপন কুণ্ডুর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীদের তরফে বেবি তেওয়ারি বলেন, ‘‘তৃণমূলের কাউন্সিলররা অনেক দুর্নীতি করেছেন। বোর্ড ভেঙে দেওয়া হলেও মানুষের কাছ থেকে ওঁরা পার পাবেন না।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘চন্দননগরবাসীকে পরিষেবা দিতে পুরসভা ব্যর্থ।’’

পুরসভা চালানোর কমিটিতে রয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক ইন্দ্রনীল সেন। এই পুরসভায় বিজেপির অভিযোগের বিষয়টি এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্নীতি রুখতে সচেষ্ট। বিজেপিকে এ নিয়ে না ভাবলেও চলবে।’’

পুর-কমিশনার স্বপনবাবু জানান, পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়ে ঘাটতি থাকলে তা খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘কাটমানি’ প্রসঙ্গে তিনি কিছু বলতে চাননি।

চুঁচুড়ায় কাউন্সিলরের বাড়ির সামনে স্লোগান

‘কাটমানি’ ফেরতের দাবি তুলে মঙ্গলবার সকালে চুঁচুড়া পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুনীল মালাকারের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখান বিজেপির জনা কয়েক কর্মী।

দু’বারের কাউন্সিলর সুনীলবাবু শহরের সাতপুকুর এলাকায় থাকেন। এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ বিজেপির জনা চারেক কর্মী তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন। দাবি তোলেন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম করে সাধারণ মানুষের থেকে নেওয়া ‘কাটমানি’র টাকা ফেরত দিতে হবে। বাড়ির সামনে রাস্তায় বসে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভের সময় সুনীলবাবুর বাড়ি থেকে কেউ অবশ্য বাইরে বেরোননি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে এলাকায়।

আন্দোলনকারীদের তরফে বৈশাখী মণ্ডল বলেন, ‘‘বাড়ি তৈরি-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে উনি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কাটমানি খেয়েছেন। অনেকেই এ নিয়ে আমাদের অভিযোগ জানিয়েছেন। সাত দিনের মধ্যে উনি টাকা ফেরত না দিলে বাড়িতে ঢুকে টাকা আদায় করে ছাড়ব।’’

অভিযোগ মানেননি সুনীলবাবু। ওই কাউন্সিলরের দাবি, তাঁর এক আত্মীয় সম্প্রতি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে ভিড়েছেন। বিক্ষোভের পিছনে তিনিই কলকাঠি নেড়েছেন। সুনীলবাবুর কথায়, ‘‘খুড়তুতো ভাইয়ের মদতে আমার নামে কুৎসা রটানো হচ্ছে। কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে পদত্যাগ করব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement