সপরিবার: পরিবারের সকলে মিলে খাওয়া-দাওয়া রেস্তরাঁয় (বাঁ দিকে) এই সেই বিজ্ঞাপন (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র
এ যেন এক ঢিলে তিন নিশানা!
ব্যবসাও হচ্ছে। এলাকার বৃদ্ধবৃদ্ধাদের ‘আশীর্বাদ’ মিলছে। বহু পরিবারে খুশিও ফিরছে।
‘বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে খেতে এলেই মিলবে ২০ শতাংশ ছাড়’— এই হোর্ডিং-ফেস্টুনে ছেয়েছে উলুবেড়িয়া শহর। চলতি বছরের গোড়া থেকে এমন বিজ্ঞাপনী প্রচার যাঁর মস্কিষ্কপ্রসূত, তিনি শহরের ওটি রোডের একটি রেস্তরাঁর মালিক সমীরণ গোস্বামী।
২০০৯ সাল থেকে ওই রেস্তরাঁ চালাচ্ছেন বাজারপাড়ার বাসিন্দা, বছর তিপ্পান্নর সমীরণ। তখন আশপাশে তেমন রেস্তরাঁ ছিল না। এখন প্রতিযোগিতা বেড়েছে। সেই প্রতিযোগিতায় তাঁর নতুন প্রচারে প্রতিদিনই ভিড় হচ্ছে। তিন তলা রেস্তরাঁ সব সময়ই ভর্তি। প্রেমিক-প্রেমিকা, যুবকের দলের পাশাপাশি বাবা-মাকে নিয়ে ভিড় বাড়াচ্ছে অনেক পরিবারও। সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন কর্মীরা। হাসি ফুটছে সমীরণের মুখে।
‘‘শুধু ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধির জন্য ওই প্রচার, এমনটা ভাববেন না। লাভ করতেই তো ব্যবসা করছি। কিন্তু লভ্যাংশের কিছুটা ছেড়ে যদি বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি— এই ভাবনাটাও ছিল। বর্তমান সময়ে ক’জন আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে রেস্তরাঁয় খেতে যান বলুন!’’— বলছেন সমীরণ।
কিন্তু এমন ভাবনাই বা কেন?
ওই ব্যবসায়ী জানান, ছ’বছর বয়সে তিনি মাকে হারিয়েছেন। মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসে গল্প করার সেই সুযোগ পাননি। বাবাকে হারিয়েছেন বছর তিনেক আগে। এখনও খেতে বসলে তাঁর বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে। তা ছাড়া, বহু বয়স্ক মানুষকে যে ভাবে কার্যত গৃহবন্দি থাকতে হয় বা বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিতে হয়, সেই কষ্টও তাঁকে নতুন ভাবে ভাবিয়েছে, এমনই দাবি সমীরণের।
শীতের এই দু’মাসে দুপুরে-রাতে নাতি-নাতনি, ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইয়ের সঙ্গে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের ভিড় জমাতে দেখা গিয়েছে ওই রেস্তরাঁয়। ক’দিন আগেই এখানে খেতে এসেছিলেন বছর সত্তরের গোপাল রক্ষিত। সপরিবারে। হোটেল-মালিকের ভাবনাকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সময়ে এইসব রেস্তরাঁ ছিল না। এসে ভালই লাগছে। একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া হল। অনেক গল্পও হল। ছেলে-বৌমা চাকরিতে ব্যস্ত থাকে। বাড়ির কাছেই যে এ ভাবে একসঙ্গে অনেকটা সময় কাটানো যায়, ভাবিনি।’’ আর এক বৃদ্ধা বলেন, ‘‘প্রথমে কিন্তু কিন্তু লাগছিল। কিন্তু এখানকার পরিমণ্ডলটা বেশ। আমি এই বয়সে কত আর খাই! কিন্তু বেশ ভাল লাগছে এমন উদ্যোগে। রেস্তরাঁ-কর্মীদের ব্যবহারেই জড়তা কেটে গিয়েছে।’’
রেস্তরাঁ-কর্মীরা বলছেন, এ অভিজ্ঞতা তাঁদের কাছেও নতুন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা মূলত কমবয়সীদের বা বিবাহিত যুবক-যুবতীদের ‘অর্ডার’ নিতেন। পরিবেশন করতেন। এখন ‘অর্ডার’ নেওয়ার আগে প্রত্যেক বৃদ্ধবৃদ্ধার থেকে তাঁরা খুঁটিয়ে সব কিছু জানেন। অনেকের অনেক কিছু বারণ থাকে। সেইমতো সব খাবার প্রস্তুত করেন। ভালমন্দের খোঁজ নেওয়া চলে দু’পক্ষেই।
‘স্যারের’ এই প্রয়াসে রেস্তরাঁ-কর্মীরও কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন।