সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্যে তৈরি হচ্ছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। গোয়েন্দা সূত্রে সেই খবর মিলতেই নড়চড়ে বসেছে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’। মনের গভীরে বাসা বেঁধেছে আতঙ্ক। ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্রে’ তাঁদেরকেই নিশানা করবে না তো জঙ্গি মুলুক? তাই আর এতটুকু সময় নষ্ট না করে নিষেধাজ্ঞার চাবুকে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণকারী দেশটিকে ‘সবক’ শেখানোর চেষ্টা করেছে তারা।
বছরশেষে আমেরিকার কাছে জোর ধাক্কা খেল পাকিস্তান। ইসলামাবাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে রীতিমতো ‘ফুলস্টপ’ বসাতে চাইছে ওয়াশিংটন। ইতিমধ্যেই চারটি পাক সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে শাহবাজ শরিফ সরকার। এর জেরে দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব বাড়বে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পাক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে বিবৃতি দেয় আমেরিকার প্রেসিডেন্টের প্রধান কার্যালয় ‘হোয়াইট হাউস’। সেখানে বলা হয়েছে, দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাজ জোরকদমে চালাচ্ছে ইসলামাবাদ। একে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড়সড় হুমকি বলে উল্লেখ করেছে ওয়াশিংটন।
এর পরই চারটি পাক সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করে আমেরিকা। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কমপ্লেক্স’ বা এনডিসি। ইসলামাবাদের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই সংস্থাই ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির নেতৃত্বে রয়েছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা আরও ভাল ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর) জন ফিনার। সম্প্রতি ‘কর্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ শীর্ষক আলোচনাচক্রে বক্তৃতা দেন তিনি। সেখানেই পাক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেন আমেরিকান প্রশাসনের এই শীর্ষকর্তা।
ফিনার বলেছেন, ‘‘ইসলামাবাদ যে ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে হাত দিয়েছে, তার পাল্লায় চলে আসবে গোটা দক্ষিণ এশিয়া। শুধু তা-ই নয়, পাক ভূমি থেকে ওই ব্রহ্মাস্ত্রের সাহায্যে আমেরিকার শহরকে নিশানা করা মোটেই কঠিন নয়। গোয়েন্দা সূত্রে এই খবর আসার পর সম্ভাব্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের বিষয়টি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে জানানো হয়। পরে প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’
ইসলামাবাদে অবস্থিত এনডিসি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিষনজরে’ পড়েছে করাচি-ভিত্তিক তিনটি সংস্থা। সেগুলি হল, আখতার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, অ্যাফিলিয়েটস ইন্টারন্যাশনাল এবং রকসাইড ইন্টারপ্রাইজ়। এই সংস্থাগুলি ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বলে সূত্র মারফত জানা গিয়েছে।
উল্লেখ্য, এই প্রথম কোনও পাক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল ওয়াশিংটন। এর জেরে ইসলামাবাদের কর্মসূচি যে অনেকটাই ধাক্কা খেল, তা বলার আপেক্ষা রাখে না। তবে আমেরিকার পদক্ষেপে দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত থেকে পাক প্রশাসন ‘ইউ টার্ন’ নেবে, এমন ভাবার কারণ নেই, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
বিশ্লেষকদের কথায়, পাক ভূমি থেকে আমেরিকাকে নিশানা করতে হলে অন্তত ১২ হাজার কিলোমিটার পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র চাই ইসলামাবাদের। বর্তমানে সেই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং চিনের কাছে। জেনারেল আসিফ মুনিরের ফৌজ ওই প্রযুক্তি পেয়ে যাক, তা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসভঙ্গে’র অভিযোগ তুলেছে আমেরিকা। ‘‘বিভিন্ন সময়ে নানা ইস্যুতে আমরা ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু বর্তমানে তাঁরাই আমাদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন চোখে দেখার সময় এসে গিয়েছে।’’ বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ফিনার।
ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করতে আমেরিকার চাপানো নিষেধাজ্ঞাকে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে শরিফ সরকার। পাক বিদেশ মন্ত্রকের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘কোনও প্রমাণ ছাড়া নিছক সন্দেহের বশে এই পদক্ষেপ করেছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।’’
ঐতিহাসিক ভাবে ভারতকে মোকাবিলা করার জন্য পারমাণবিক হাতিয়ার এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে এসেছে ইসলামাবাদ। যদিও নয়াদিল্লির মতো স্থল, জল ও আকাশ থেকে আণবিক হামলা চালানোর ক্ষমতা এখনও অর্জন করতে পারেনি পাক সেনা। ফলে মুনির ফৌজের উপর যুক্তরাষ্ট্রের কড়া মনোভাবের নেপথ্যে অন্য কারণ খুঁজে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
গত বছর (পড়ুন ২০২৩) থেকে চলা পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে সরাসরি ইরান মদতপুষ্ট ‘হামাস’ বা ‘হিজ়বুল্লা’র মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে ইসলামাবাদ। অন্য দিকে বরাবরাই ইজ়রায়েলকে শত্রু বলে মনে করে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর। ফলে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারলে পাক সেনার পক্ষে তা ইহুদিদের ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করা আশ্চর্যের হবে না। আর সেই আশঙ্কা থেকেই ‘বন্ধু’ ইজ়রায়েলকে বাঁচাতে আগাম সতর্কতা হিসাবে আমেরিকা পদক্ষেপ করল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের হলেও এতে নানা জটিলতা রয়েছে। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখল করে সোভিয়েত রাশিয়া। ফলে মধ্য এশিয়ায় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মস্কোর প্রভাব। পরবর্তী এক দশকে আফগানিস্তানকে সোভিয়েত-মুক্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল আমেরিকা। আর এই কাজে ‘দাবার বোড়ে’ হিসাবে পাকিস্তানকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র।
আফগানিস্তানকে সোভিয়েত দখলমুক্ত করতে ‘মুজাহিদিন’ বা ধর্মযোদ্ধা তৈরি করে আমেরিকান গুপ্তচর সংস্থা ‘সিআইএ’। করাচির বন্দর হয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় হাতিয়ার। তবে ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে বার বার সেনা অভ্যুত্থানকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি ওয়াশিংটন। ইসলামাবাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর ‘পেন্টাগনের’ যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ‘টুইন টাওয়ার’-এ জঙ্গি হামলার পর ফের খুব কাছাকাছি চলে আসে দুই দেশ। ওই ঘটনার মূলচক্রী কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আল কায়দা’কে সমূলে বিনাশ করাই তখন ছিল পেন্টাগনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। এতে পাক সেনা ও সরকারের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। চিনের সঙ্গে অতিরিক্ত মাখামাখি এর মূল কারণ বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। গত দু’-তিন বছরে বেশ কয়েক বার পাকিস্তানকে ‘বিপজ্জনক’ রাষ্ট্র বলে তকমাও দিয়েছেন খোদ প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
সম্প্রতি আবার ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাকমেলিং’য়ের অভিযোগ তুলেছে বেজিং। ড্রাগনের অভিযোগ, গ্বাদর বন্দরে নৌসেনা ঘাঁটি তৈরি করতে দেওয়ার বদলে দ্বিতীয় আঘাতে সক্ষম পরমাণু প্রযুক্তি চেয়েছে পাক সেনা। যদিও ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ প্রকল্পের আওতাভুক্ত ওই বন্দর স্বাভাবিক ভাবে হাতে পাওয়ার কথা রয়েছে লালফৌজের।
আমেরিকা ও চিন, এই দুই মহাশক্তিধরের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্কের সামান্য অবনতি হওয়ায় যথেষ্ট স্বস্তি পেয়েছে নয়াদিল্লি। তবে এই ধরনের পরিস্থিতিতে উত্তর কোরিয়া বা তুরস্কের কাছে সাহায্য চাইতে পারে পাকিস্তান। অতীতে বহু বার ইসলামাবাদকে যা করতে দেখা গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে অন্য দেশের প্রযুক্তির সাহায্যে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা মুনির ফৌজের পক্ষে খুব কঠিন হবে না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।