—প্রতীকী ছবি।
কেউ বলছেন, মুড়ি-মিছরি এক দর কেন হবে? কেউ প্রশ্ন তুলছেন, অন্যের দোষে কেন তাঁকে সাজা পেতে হবে, অপমানিত হতে হবে?
সোমবার হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে ২৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের নির্দেশের পরে এমনই ক্ষোভ ছড়াচ্ছে শিক্ষকদের অনেকের মধ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যানিংয়ের এক শিক্ষকের ক্ষোভ, ‘‘দুর্নীতি করল কয়েক জন, কিন্তু ফল ভুগতে হচ্ছে সকলকে!’’ তাঁর ক্ষোভ, হাই কোর্ট যোগ্য-অযোগ্য সকলের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেওয়ার ফলে সার্বিক ভাবে শিক্ষকদের সকলকে সামাজিক মর্যাদাহানির মুখে পড়তে হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘রায় ঘোষণার পর থেকে রাস্তায় বেরোতে পারছি না। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ খুললেই সেখানে শিক্ষক-সমাজ সম্পর্কে নানা অপমানজনক কথা দেখছি! কী যে করব বুঝতে পারছি না।”
একই প্রশ্ন বাসন্তী হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক বিশ্বজিৎ মণ্ডলের। তিনি বলেন, “রীতিমতো পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছি। কিন্তু রায় দেওয়ার আগে আদালত আমাদের কথা এক বারও ভাবল না? যাঁরা সত্যিই নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের এ হাল হবে কেন!’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কী ভাবে এখন চলবে সংসার, পরিবার? এটা দেখার দায়িত্ব কি আদালতের নেই!”
কেবল অনিশ্চিত ভবিষ্যতই নয়, সামাজিক সম্মানহানির আঘাত কী ভাবে তাঁরা সামলাবেন, সেই চিন্তায় ঘুম উড়েছে বহু শিক্ষকের। হাসনাবাদ থানার বিশপুর হাইস্কুলের শিক্ষিকা মৌমিতা মল্লিক দমদমের বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘‘চাকরি যে দিন থেকে পেয়েছি, সে দিন থেকেই অনেকের তির্যক মন্তব্য শুনি ভুয়ো শিক্ষক কি না, তা নিয়ে। এখন চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেওয়ায় মুড়ি-মিছরি এক হয়ে গেল!’’
বহু শিক্ষকই জানাচ্ছেন, পরিচিতেরা অনেকেই তাঁদের সোমবার থেকে ফোন করে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছেন। তাতে তাঁরা আরও লজ্জায় পড়ছেন। মৌমিতার কথায়, ‘‘এখন তো বাইরে বেরোতেই ভয় করছে। মনে হচ্ছে পরিচিত কারও সামনে পড়ে গেলে সে আবার এই নিয়ে কী জিজ্ঞাসা করবে!’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘সকলে তো টাকা দিয়ে চাকরি পায়নি। দোষীদের জন্য আমরা যারা নির্দোষ, তারা কেন এমন যন্ত্রণা ভোগ করব কেন?’’
হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের সাহেবখালি নিত্যানন্দ হাই স্কুলের এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘এক বছর হল বিয়ে করেছি। টিভিতে চাকরি বাতিলের খবর দেখে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন আসছে একের পর এক। স্ত্রীর কাছেও লজ্জায় পড়ে গেলাম।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মঙ্গলবার সকালে ব্যাঙ্কে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম, বেতনের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে হবে কি না তা নিয়ে। খুব লজ্জা করছে।’’
এই পরিস্থিতিতে সরকারি স্কুলের প্রতি অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের মনোভাব খারাপ হবে বলে মনে করছেন অনেকে। আখেরে তাতে বেসরকারি স্কুলের প্রতি আগ্রহ বাড়বে তাঁদের মত। মথুরাপুরের কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দনকুমার মাইতি বলেন, ‘‘এমনিতেই বহু স্কুলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী যথেষ্ট কম। আবার এত শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ায় পড়াশোনা ব্যাহত হবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘ওই শিক্ষকেরা যে বেতন পেতেন, সেই বেতনে অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করে আপাতত পঠনপাঠন স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা করুক সরকার।’’
হাই কোর্টের রায়ে বেতন ফেরানোর নির্দেশ নিয়েও ভিন্নমত পোষণ করেছেন প্রধান শিক্ষকদের একাংশ। সে প্রসঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, ‘‘যাঁদের চাকরি বাতিলের নির্দেশ হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসার জন্য বেতন পেয়েছেন এত দিন ধরে। তা সুদ সহ ফেরাতে বললে তাঁদের পরিশ্রমের হিসেব কী করে হবে?’’ এক প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘‘সকলেই তো টাকা দিয়ে চাকরি পাননি। চাকরি পেয়ে কেউ ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন। ভাল স্কুলে ভর্তি করে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। তাঁরা কী ভাবে সংসার চালাবেন?’’