কারখানায় শৈলেন মণ্ডল।
দীর্ঘ প্রায় দু’মাস ছুটির পর সোমবার খুলেছে স্কুল। আর প্রথম দিনই প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে বছর ষোলোর এক ছাত্রের আবেদন, ‘সপ্তাহে দু’দিন আসতে পারব। অন্য দিন কাজ করতে যাব।’’ কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলেন উলুবেড়িয়া জগৎপুর আনন্দ ভবন ডেফ অ্যান্ড ব্লাইন্ড স্কুলের প্রধান শিক্ষক অজয় দাস। সপ্তম শ্রেণিরওই ছাত্র শৈলেন মণ্ডলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন কারণ। সব শোনার পর দেন সম্মতি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ছোট থেকেই জগৎটা অস্পষ্ট বাগনানের নবাসনের বাসিন্দা শৈলেনের কাছে। সে আংশিক দৃষ্টিসম্পন্ন। তবে শুধুসে নয়। তার বাবা, দাদা আর বোনেরও একই সঙ্কট। বাবা অষ্ট মণ্ডল বয়সজনিত কারণে কাজকরতে পারেন না। শৈলেনের দাদা সৌমেনের কাজ গিয়েছেলকডাউনে। বছর আঠারোর সেই তরুণ আর কোনও কাজ জোগাড় করতে পারেননি। বোন বিষ্ণুপ্রিয়া জগৎপুর আনন্দ ভবন ডেফ অ্যান্ড ব্লাইন্ড স্কুলেরই পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। সংসারের রোজগার বলতে এক হাজার করে বাবা ও তিন ভাইবোনের প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে মেলেচার হাজার টাকা আর শৈলেনেরমা লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে পান৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে সাড়েচার হাজার টাকায় সংসারচালানোই দায়।
সম্প্রতি শৈলেনের মা শ্রাবন্তীর গলায় টিউমার ধরা পড়ে। ২০ হাজার টাকা ধার করে চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ। যে ব্যবসায়ীর থেকে শৈলেন টাকা ধার নিয়েছিল, তাঁর ছাতার কারখানায় কাজ করে ধার মেটাচ্ছে সে।শৈলেনের কথায়, ‘‘ছুটির সময় ওই দোকানে সারা সপ্তাহ কাজ করছিলাম। মাসে আড়াই হাজার টাকা বেতন মেলে। এ ভাবে ধার মেটাব।’’ এ দিন প্রধান শিক্ষককে শৈলেন বলেন, ‘‘কাজ না করলে ধার মেটাতে পারব না। তাই সপ্তাহে দু’দিন স্কুলে আসব। বাকি দিন কাজে করতে যাব কারখানায়। তবে পড়া ছাড়ব না।’’
ছুটির পর সোমবার প্রথম স্কুল খোলার আনন্দে সব পড়ুয়ারাই ছিল মাতোয়ারা। কিন্তু ক্লাসে মনমরা হয়ে বসে ছিল শৈলেন। অজয়বাবু বলেন, ‘‘এই স্কুলে যারা পড়তে আসে প্রতিবন্ধকতা তাদের কাছে বড়লড়াই। শৈলেনের লড়াই আরও শক্ত। এত কম বয়সে সংসারের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সে। আপাতত দু’দিনই ক্লাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে ওকে। সব রকম সহযোগিতারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।’’
যাঁর কারখানায় শৈলেন কাজ করে, সেই ব্যবসায়ী মণীন্দ্র মণ্ডলও পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। মণীন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘ওদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। এলাকার কেউ ধার দিতে চায়নি। আমি দিয়েছিলাম। শৈলেন কথা দিয়েছে, টাকা শোধ করব। আমার কোনও তাড়া নেই। পড়াশোনার পর ধার শোধ করলেও আপত্তি নেই। শৈলেন পড়াশোনা করে বড় হোক, এটা আমরাও চাই।’’