বিশ্বকাপে ফ্রান্সের সমর্থকদের উন্মাদনা চন্দননগর স্ট্র্যান্ডে। রবিবার রাতে। ছবি: তাপস ঘোষ
ফাইনাল শুধু নয়, বিশ্বকাপ জুড়ে ফ্রান্স সত্যিই অসাধারণ খেলেছে। এমবাপে অতুলনীয়। কিন্তু তারা ফাইনালে উঠেছে বলে একসময়ে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শহর চন্দননগরের এক শ্রেণির বাসিন্দা ‘ফ্রান্সের জয়, আমাদের জয়’ বলে উদ্বাহু নৃত্য করবেন, জয়ের জন্যে যজ্ঞ করবেন, এটা কতটা মেনে নেওয়া যায়!
রবিবার রাতে এমনটাই দেখা গিয়েছে স্ট্র্যান্ডে এবং শহরের কিছু এলাকায়। ফরাসি পতাকা ঝোলানো তো ছিলই। কোথাও বাড়িতে আলো লাগানো হয় ফ্রান্সের পতাকার রঙে। চন্দননগর স্টেশন রোডে যজ্ঞ হয় ফ্রান্সের জয় কামনায়। খেলার আগে থেকেই ফ্রান্সের জন্য সমর্থকদের নাচানাচি, পতাকা বা খেলোয়াড়দের ছবি নিয়ে হুটোপাটি, স্লোগান, বাজি, পোড়ানো— সবই ছিল। স্ট্র্যান্ডে বল নাচাতেও দেখাযায় অত্যুৎসাহীদের। সেখানে প্রচুর ভিড় হওয়ায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়।
১৯৯৮ বা ২০০৬ সালে যখন ফ্রান্স বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠেছিল, তখনও এতটা ফরাসি-প্রীতি দেখা যায়নি। আমি নিজে দেখেছি, সেই সময়ে শহরে একটা ফ্রান্সের পতাকা খুঁজতেও ফটোগ্রাফারকে নাজেহাল হতে হয়েছিল। মনে আছে, একবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে এখানকার মেয়র বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘‘ না, ফ্রান্স জেতায় এখানে কোনও উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে না।’’
২০১৮ থেকে এই ট্রেন্ডটা শুরু হয়। স্ট্র্যা ন্ডে, এমনকি এখানকার মিউজিয়ামে ফ্রান্সের দলের খেলোয়াড়দের ছবি দেওয়া বিরাট ফেস্টুন টাঙিয়ে ‘ফ্রান্সের জয়, আমাদের জয়’ লিখে গর্ব করা হয়েছিল। সেই একই আবেগ এ বারেও এখানকার কতিপয় নাগরিকদের মধ্যে দেখা গেল।
মনে হয়, এখানকার সাধারণ নাগরিকদের একাংশ শহরের ইতিহাস না জেনেই চন্দননগরকে ফরাসি-শহর বলে গর্ববোধ করেন। সেটা তাঁদের ভুল শিক্ষার ফল। এ তো দেখছি, ভিয়েতনাম বা কিউবা উৎসব করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য! বাংলাদেশ করছে পাকিস্তানের জন্য! ইংল্যান্ড জিতলে কলকাতার লোকদের ইউনিয়ন জ্যাক নিয়ে নাচানাচি করতে কখনও দেখেছি আমরা?
অনেকেই বলেন, ফরাসি সরকার আমাদের অনেক যত্নে রেখেছিল। প্রজাদের উপর কোনও অত্যাচার করেনি। গোটা শহরটাকে সাজিয়েছিল। এমনই সব ভুল ইতিহাস জেনে ফ্রান্সকে নিয়ে গর্ব করেন চন্দননগরের নাগরিকদের একাংশ।
একসময়ে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ হুগলি নদীর তীরে বাণিজ্যের কারণে বসতি স্থাপন করে। পরে কুঠি গড়ে, উপনিবেশ স্থাপন করে। ফরাসিরাও এ শহরে নিজেদের বাসস্থানের জায়গাটুকুই সাজিয়ে নিয়েছিল। এবং তা করে এখানকার অধিবাসীদেরই করের টাকায়। উপনিবেশ গড়ে রাজত্ব চালানোর সময়ে এরা সব কিছুর উপরেই কর চাপিয়েছে। এখানকার নাগরিকদের বিয়ে, বাড়িঘর তৈরি, নদী-পুকুর থেকে মাছ ধরা, এমনকি, নিজের জমিতে ধান বা অন্য শস্য তুলতেও কর দিতে হত। জমি-সম্পত্তি হস্তান্তরেও ছিল করের বোঝা।
স্থানীয় নাগরিকদের বাসস্থানকে ওদের ভাষায় বলা হত ‘কালো অঞ্চল’ (Vill Noire)। সে সব অঞ্চলের প্রতি ওদের কোনও নজরই ছিল না। এ কথা সত্য, সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে চন্দননগরের ঐতিহ্য প্রাচীন কাল থেকেই। সেটা ছিল তাদের নিজস্ব লোকসংস্কৃতি। কুটির শিল্পেও এই শহর এক বিস্ময়কর উন্নতি করেছিল। এখানকার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতির কথা কে না জানে! ফ্রান্সে চন্দননগরের খ্যাতি ছিল ‘রফতানিকারক দেশ’ হিসেবে। এখানকার তুলো ও বস্ত্রশিল্প ভারতের গৌরব ছিল। চাষও হত। শস্য বা তুলোর চাষ বন্ধ করে এখানে শুরু হয়েছিল নীল চাষ। সব মুছে গিয়েছিল ওদের বদান্যতায়।
মূলত বাণিজ্যের প্রয়োজনে এখানে কুঠি গড়ে রাজত্ব শুরু করে ফরাসিরা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর এখানে শুরু হয় ফরাসি শিক্ষা আর ওদের সংস্কৃতির আগ্রাসন। সরকারি স্কুলগুলিতে ফরাসি ইতিহাস ও ভাষা শিক্ষা শুরু হয়।
ফরাসিদের সম্বন্ধে আর একটি কথা শোনা যাচ্ছে। সেটা— ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে চন্দননগর এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল ফরাসি সরকারের সাহায্যে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই শহর বিপ্লবীদের এক কর্মকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এবং সেটা হয়েছিল ফরাসি সরকারের মদতে। এটাও ভুল তথ্য। যেহেতু ফরাসি অধীনস্থ চন্দননগরে ব্রিটিশ আইন বা শাসন চলত না, ফলে, এখানে অনেক বিপ্লবী আত্মগোপন করার সুযোগ নিতেন। যেহেতু বিপ্লবীরাও ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করত না, ফলে ফরাসিরাও এঁদের ঘাঁটাতেন না। কিন্তু ইংরেজরা সুযোগ পেলেই এখানে এসে তাঁদের ধরে নিয়ে যেত বা হত্যা করত। ফরাসি সরকার ইংরেজদের কিছুই বলত না।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও শহরটিকে নিজেদের দখলে রাখতে চেয়েছিল ফরাসি শাসকের দল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ফরাসিরা তো চাইবেই তাঁদের গৌরবগাথা এখনও, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও তুলে ধরতে। আর এ সব জেনেও এমন 'স্বর্ণোজ্জ্বল' ইতিহাস স্মরণ করে যদি চন্দননগরের এক শ্রেণির মানুষ ফ্রান্সের জয়ধ্বনি দেন, সেটা কি শহরের পক্ষে গৌরবের? এতে আত্মসম্মান বাড়ে?