স্মৃতি: ১৯৬২ সালে উস্তাদ আমজাদ আলি খানের প্রথম অনুষ্ঠান এই সম্মেলনেই। ছবি সৌজন্য: সঙ্গীতচক্র
একজন দর্শক-শ্রোতা হিসাবে সঙ্গীতচক্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ৫০ বছরেরও বেশি। অনেক কথা মনে পড়ছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি!
শুরু করি ১৯৬৭ সালের কথা দিয়েই। সে বছর অনুষ্ঠান ছিল এক রাতের। কত্থক নাচ মঞ্চস্থ করেছিলেন গুরু গোপীকৃষ্ণ। ওই একবারই তিনি সঙ্গীতচক্রে আসেন। ওই রাতেই আরেক শিল্পী ছিলেন গজল সম্রাজ্ঞী বেগম আখতার। তিনিও ওই একবারই এসেছিলেন।
যাক, যে কথা বলছিলাম। আকাশবাণী থেকে বেগম আখতারের অনুষ্ঠানটি সর্বভারতীয় পর্যায়ে সম্প্রচার করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বেগম আখতার ও সঙ্গীতচক্র কর্তৃপক্ষ সম্মতি জানান। রাত ১১টা থেকে ওই অনুষ্ঠান হবে। সে জন্য কলকাতা টেলিফোনের লাইন দিয়ে পুরো অনুষ্ঠান কলকাতা আকাশবাণীতে পাঠানোর ব্যবস্থা হল। রাত সাড়ে ন’টায় গোপীকৃষ্ণজির অনুষ্ঠান ঠিক হল। ওঁকে বলা হল, পৌনে ১১টায় মঞ্চ ছাড়তে। যাতে ঠিক ১১টা থেকেই বেগম আখতারের অনুষ্ঠান শুরু করা যায়। নাচের সমুদ্রে ডুবে গিয়ে গোপীজি সময় ভুলে গেলেন। এ দিকে, আকাশবাণী ও সঙ্গীতচক্র কর্তৃপক্ষের মাথায় হাত! বাধ্য হয়েই একরকম জোর করে ১০টা ৫০ মিনিটে গোপীজিকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনা হয়। ঠিক ১১টাতেই বেগম আখতারের অনুষ্ঠান আকাশবাণী থেকে সম্প্রচারিত হয়। এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। পরে অবশ্য আকাশবাণী ও সঙ্গীতচক্র কর্তৃপক্ষ গোপীজির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। গোপীজিও ভুল বুঝতে পেরে ব্যাপারটা মিটমাট করে নেন।
১৯৮০ সালে উস্তাদ বিসমিল্লা খানের সানাইয়ের সুর এখনও কানে বাজে। শেষ রাতের সেই ভৈরোঁতে সানাই। এ বছর সরোদ সম্রাট আলি আকবর খানের জন্মশতবর্ষ। ১৯৯৭ সালে উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্র তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। ওই আসরে তিনি সরোদে এক অনুপম সৃষ্টির মায়াজাল বুনেছিলেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে নিজেদের পরিবারে কালীপুজোর কথা বলেছিলেন তিনি।
১৯৮২ সালে উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্রের রজতজয়ন্তী বর্ষ হয়। ওই অনুষ্ঠানে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার বাজানোর কথা। রবিশঙ্করজি আগের দিন মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) অনুষ্ঠান করে সরাসরি সঙ্গীতচক্রে চলে আসবেন, এমনই ঠিক ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে হঠাৎ দেশে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ দিকে, সঙ্গীতচক্র কর্তৃপক্ষের মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা! সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। অনুষ্ঠান কি বন্ধ করতে হবে? যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
ও দিকে, রবিশঙ্করজি সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সামরিক বিমানে কলকাতায় নেমে সরাসরি সঙ্গীতচক্রের মঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন। সঙ্গীত ও সঙ্গীতচক্রকে ভালবেসে তিনি এই অসাধ্য সাধন করেন। এ-ও এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
১৯৯৫ সালে সঙ্গীতচক্রের আসরে তিন নক্ষত্রের সমাবেশ। উস্তাদ আমজাদ আলি খান, উস্তাদ জাকির হোসেন ও বেগম পারভিন সুলতানা। কী অসাধারণ সাঙ্গীতিক পরিবেশ!
শেষ করছি আর একটি ঘটনা দিয়ে। ১৯৯৭ সাল। সঙ্গীত পরিবেশন করছেন পণ্ডিত যশরাজজি। শুরু করেছেন আলাপ। ও দিকে, ভাগীরথীর ও পাড় থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে। পণ্ডিতজির কানেও পৌঁছল সেই ধ্বনি। তিনি পাশে বসা সঙ্গতকার আনন্দগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘণ্টাধ্বনির উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আনন্দজি বললেন, ভাগীরথীর অপর পাড়ে রয়েছে দক্ষিণেশ্বর মন্দির। রাতে মা ভবতারিণীর শয়নারতির ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। তারপরেই এক ঐশ্বরিক অনাবিল আনন্দের উৎসমুখ খুলে গেল। পণ্ডিতজি ধরলেন রাগ ‘আড়ানা’য় মাতা কালিকা! এক অনির্বচনীয় আনন্দের স্রোত বইল সঙ্গীতচক্রের আসরে। এই রাগ শেষ করেই ধরলেন ‘আল্লা মেহেরবান’। দরাজ কন্ঠের ঈশ্বর আবাহনের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল সেটি। প্রাদেশিকতা, ধর্মান্ধতা দূরে ঠেলে দিয়ে প্রকৃত সাঙ্গীতিক সুষমায় মহিমান্বিত হল সঙ্গীত সম্মেলন। জয় হল মানবতার, মানবাত্মার।
লেখক ১৯৯৫ থেকে সঙ্গীতচক্রের কর্মকর্তা