ত্রাতা: সৌমেন দাস। নিজস্ব চিত্র।
সংসারের প্রতিকূলতা, অভাব-অনটনের সঙ্গে ওঁর লড়াই চলে রোজ। মঙ্গলবার এক অন্য লড়াইতেও নামলেন সৌমেন দাস। এবং জিতলেন।
চুঁচুড়া পুরসভার অস্থায়ী নিরাপত্তাকর্মীর কাজে আর ক’টাকাই বা মেলে! তাই প্রতিদিন সকালে শহরের ময়ূরপঙ্খী ঘাটে টেবিল পেতে লটারির টিকিট বিক্রি করতে বসে পড়েন স্থানীয় যুবক সৌমেন। এখনও সে ভাবে কারও ভাগ্য ফেরাতে পারেননি। তবে, এ দিন ইদ ও অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে তিনি গঙ্গার স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে বাঁচিয়ে দিলেন আত্মঘাতী হতে চাওয়া এক মহিলাকে। বছর তিরিশের এক সাধারণ যুবক থেকে ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে সৌমেন হয়ে উঠলেন পাড়ার গর্ব।
ঘটনাটি ঘটে আচমকাই। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে। মোবাইলে কারও সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলতে বলতে রাস্তা ধরে প্রায় দৌড়চ্ছিলেন বছর বিয়াল্লিশের ওই মহিলা। অনেকেই দেখেছেন সে দৃশ্য। আচমকা মহিলা ঘাটে এসে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামতে থাকেন। স্নানার্থীরা দেখেন, প্রায় শেষ ধাপের কয়েকটি সিঁড়ির আগে মহিলা মোবাইলটি রেখে দেন। তলায় চাপা দিয়ে দেন হাতে থাকা কিছু টাকা। তারপর সটান ঝাঁপ গঙ্গায়।
মহিলাকে ওই ভাবে টাকা এবং মোবাইল রাখতে দেখেই সৌমেনের মনে কু ডেকেছিল। মহিলা ঝাঁপ দিতেই জলের স্রোতে কিছুটা ভেসে যান। ডোবার মুহূর্তে বাঁচার আশায় হাত দু’টো তাঁকে তুলতে দেখে আর কালক্ষেপ করেননি সৌমেন। ভিতরে হাফ-প্যান্ট পরাই ছিল। জামা-প্যান্ট খুলে তিনিও সোজা ঝাঁপ দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাঁতরে মহিলার কাছে পৌঁছে সৌমেন তাঁর হাতের মুঠো ধরে ফেলেন। তারপর শক্ত করে চেপে ধরে স্রোতের প্রতিকূলে বাঁক নিয়ে পাড়ের দিকে টেনে নিয়ে আসেন। মহিলা তখন প্রায় অচৈতন্য। ঘাটে থাকা লোকজনের সাহায্যে সৌমেন তাঁকে সিঁড়িতে তোলেন। নিজেই মহিলার মুখে জলের ঝাপটা দেন। মহিলার হুঁশ ফেরে।
খবর পেয়ে পুলিশ আসে। ঘাটে থাকা সকলেই মহিলার নাম-পরিচয়, ঘটনার কারণ জানতে উৎসুক হয়ে পড়েন। পুলিশ মহিলাকে চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। এরপর পুলিশই তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। মহিলা চুঁচুড়ারই বাসিন্দা।
এর আগে রাস্তাঘাটে বিপদে পড়া পশুপাখিকে বাঁচিয়েছেন সৌমেন। এ বার এক ডুবন্ত মহিলাকে বাঁচাতে পেরে তিনি আরও আনন্দিত। মা, দাদা-বৌদি, স্ত্রী এবং দু’টি শিশুকে নিয়ে সৌমেনের পরিবার। কোনও রকমে দিন চলে। তাঁর কথায়, ‘‘জলে ঝাঁপ দেওয়ার আগে পণ করে নিই, যে ভাবেই হোক, ওঁকে বাঁচাব। সফল হয়েছি। এমন একটা দিনে একজনকে বাঁচাতে পেরে খুবই ভাল লাগছে।’’
স্থানীয় বাসিন্দা জয়দেব অধিকারী বলেন, ‘‘সৌমেন আমাদের এলাকার গর্ব। চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটলেও অনেকেই নিজের প্রাণের মায়ায় অন্যকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে সাহস করেন না। সৌমেন ব্যতিক্রম।’’
চন্দননগর কমিশনারেটের এক কর্তা জানান, মহিলাকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তিনি কেন আত্মঘাতী হতে গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সৌমেনের সাহসের প্রশংসা করেছেন ওই পুলিশকর্তাও।