বৈদ্যবাটীতে জিটি রোডে একাধিক জায়গায় এ ভাবেই গাছ উপড়ে গিয়েছিল আমপানে। নিজস্ব চিত্র।
সব সবুজ ফিরল না
শুধু হাওড়া জেলাতেই লক্ষাধিক গাছ ভেঙে বা উপড়ে গিয়েছিল। অন্তত ৭০ হাজার গাছ পড়ে গিয়েছিল হুগলিতে। তার পুরোটা এখনও ফিরল না। প্রশাসনিক স্তরে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ ছিল না, এমনটা নয়। কিন্তু ফাঁক পুরোপুরি ভরাট হয়নি বলেই দাবি পরিবেশকর্মীদের। তাঁদের মতে, যে সব গাছ লাগানো হয়, তার অনেকগুলি ইতিমধ্যে দেখভালের অভাবে নষ্টও হয়ে গিয়েছে।
হাওড়া জেলা পরিষদ সূত্রের খবর, গোটা জেলায় অন্তত তিন লক্ষ গাছ লাগানো হয়েছে। আমপানে সবচেয়ে বেশি গাছ ভেঙে পড়েছিল গড়চুমুক পর্যটনকেন্দ্রে। সেই গাছ নিলাম করা হয়। সেই টাকা পর্যটনকেন্দ্রের উন্নতিতে ব্যবহার করা হবে।
হুগলিতে ঝড়ের পরেই বহু মানুষ ভেঙে পড়া গাছ নিজেদের ইচ্ছেমতো বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে সরকারি গাছও ছিল। বিধিসম্মত ভাবে টেন্ডার করে সরকারি গাছ কেন বিক্রি করা হল না, এ প্রশ্নও উঠেছিল। তৎকালীন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় তদন্তের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই তদন্তের গতিপ্রকৃতি এখনও জানা গেল না।
জেলা বন দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমপানে এই জেলায় বন দফতরের কত গাছ পড়েছিল, সেই সমীক্ষার কাজ শুরু হয়েছিল ঠিকই। তবে, দফতরের কাজের গতির প্রশ্নে কিছু সমস্যা আছে। পর্যাপ্ত কর্মী নেই। উচ্চতর প্রশাসনিক মহলের সিদ্ধান্তমতো তদন্তের কাজ শুরুও হয়। কিন্তু কাজে গতি ছিল না।’’
সবুজ ফেরাতে জেলা প্রশাসন অবশ্য ঢাকডোল পিটিয়ে ‘সবুজমালা’ প্রকল্প চালু করে। তাতে জেলার ২০৭টি পঞ্চায়েত এলাকায় দু’ভাবে গাছের চারা বিলি করা হয়। এক, সরাসরি পঞ্চায়েতগুলিকে তাদের চাহিদামতো গাছ দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্রামবাসীদের ফলের বাগান করতে উৎসাহিত করা হয়। এক বছর পরে সেই সবুজ বাঁচানোর উদ্যোগ এখন অনেকটাই ফিকে।
জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত স্তরে যাঁরা ফলের গাছের চারা নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই তা রক্ষা করেছেন। কিন্তু পঞ্চায়েত স্তরে সেই উদ্যোগ চোখে পড়েনি। তবে, বিচ্ছিন্ন ভাবে বলাগড়ে অসম লিঙ্ক রোডের ধারে এবং মগরা-১ পঞ্চায়েতে কিছু সুপুরি গাছ বাঁচানো গিয়েছে।’’
এখনও বে-ঘর
ঘূর্ণিঝড়ে ঘরহারা, ক্ষতিগ্রস্ত সকলের কি সুরাহা হয়েছে? এক বছর পরেও কিন্তু ইতিউতি না শোনা যাচ্ছে। স্বামী-সন্তানকে নিয়ে এখনও আত্নীয়ের বাড়িতে মাথা গুঁজে রয়েছেন বৈদ্যবাটী পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের চক নতুনপাড়ার বাসিন্দা সনকা ওঁরাও। দরমার বেড়া আর টালির চালের ঘর ছিল তাঁদের। আমপানে পড়ে যাওয়া সেই ঘর কোনও রকমে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু থাকা সম্ভব হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় নাম থাকলেও টাকা পায়নি পরিবারটি। স্থানীয় বিধায়ক তথা বিদায়ী পুরপ্রধান অরিন্দম গুঁইন বলেন, ‘‘ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা সরাসরি তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে গিয়েছে। পরবর্তী সময়ে ওই খাতে কোনও টাকা আসেনি। ফলে, আর কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি।’’
ফিরেছে পরিকাঠামো
ঝড়ে দুই জেলাতে শুধু অসংখ্য গাছ নয়, ভেঙে পড়েছিল অগুন্তি বিদ্যুতের খুঁটি, কাঁচা ঘরবাড়িওও। বহু রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেই ‘ক্ষত’ অবশ্য সারানো হয়। এক বছর পরে সেই ধ্বংসস্তূপের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, শুধু হাওড়াতেই ১৫ হাজার বাড়ি পুরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৫০ হাজার বাড়ি। অন্তত ১১০০ বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ে। হুগলিতে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৭,২২৬টি বাড়ি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ৪৯,৭৮৬টি।
প্রসঙ্গ: দুর্নীতি
আমপানে ক্ষতিপূরণের টাকা বিলিকে কেন্দ্র করে স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ভুরি ভুরি। যে কারণে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ঝড়ের পরে প্রথম দফায় পঞ্চায়েতের করা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা বাতিল করে বিডিওদের নেতৃত্বে টাস্ক ফোর্স গঠন করে নতুন ভাবে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়।
কিন্তু এক বছর পরেও দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হল কই? নির্দেশ সত্ত্বেও সব ‘ভুয়ো ক্ষতিগ্রস্ত’কে দেওয়া টাকা কি ফিরল সরকারের কাছে? এখনও দুই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর মিলল না।
হাওড়ায় সাঁকরাইল ও পাঁচলায় অভিযোগের সংখ্যা ছিল বেশি। তৃণমূল শাসিত সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতি এবং ডোমজুড় ও জগৎবল্লভপুর ব্লকের অধীন কয়েকটি পঞ্চায়েতের পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা জানানো হয়েছিল। অভিযুক্তদের পঞ্চায়েত সমিতি এবং পঞ্চায়েতের বিভিন্ন পদ থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও সেইসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কার্যকর করতে দলের তরফ থেকে কোনও রকম তৎপরতা দেখা যায়নি। ফলে, ওইসব অভিযুক্তেরা নিজেদের পদেই যে শুধু থেকে গিয়েছেন তা নয়, বিধানসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের হয়ে কাজও করেছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জয়ন্ত ঘোষের কথাই ধরা যাক। দল তাঁকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিল। তিনি এখনও স্বপদে বহাল আছেন। এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি জয়ন্তবাবু বা জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, সব মিলিয়ে ১০০ জন ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরত দিয়েছেন।
হুগলিতেও ছিল অভিযোগের বন্যা। এখানেও তার নিষ্পত্তি হয়নি। কারও বিরুদ্ধে কার্যত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় চণ্ডীতলার গরলগাছা পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান মনোজ সিংহকে দল সেই সময় বহিষ্কার করেছিল। পদত্যাগেরও নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি স্বপদেই রয়ে গিয়েছে। বিধানসভা ভোটে দলের হয়ে কাজও করেছেন।
দুর্নীতির তদন্ত নিয়ে জেলা প্রশাসনের এক কর্তার দাবি, “ব্লকগুলো থেকে তদন্ত করে সর্বত্রই নোটিস পাঠানো হয়েছিল। টাকাও ফেরত এসেছে।” মোট কত টাকা ফেরত এসেছে সেই হিসেব অবশ্য তিনি দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘‘ওই হিসেব জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। ব্লকগুলির কাছে থাকবে। অনেকেও নিজেরাও ট্রেজারিতে গিয়ে টাকা ফেরত দিয়েছেন।”
সিপিএমের আরামবাগ এরিয়া কমিটির সম্পাদক পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দুর্নীতি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ হয়নি। দুর্নীতি করে ধরা পরে গিয়ে কেউ টাকা ফেরত দিলে তো আর অপরাধ স্খালন হয় না।” একই ক্ষোভ বিজেপির আরামবাগ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা পুরশুড়ার বিধায়ক বিমান ঘোষেরও।
চাষের অবস্থা
হুগলিতে সবচেয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল চাষ। কৃষি ও উদ্যানপালনে জেলার মোট ২০৩০টা মৌজার ১০০ শতাংশই ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ধার্য হয় প্রায় ৬৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু গত এক বছরে ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পে অতিরিক্ত একটি কিস্তির টাকা ছাড়া কিছুই মেলেনি বলে চাষিদের অভিযোগ।
ক্ষতিপূরণ নিয়ে চাষিদের অসন্তোষ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন জেলা কৃষি আধিকারিক জয়ন্ত পাড়ুই। তিনি শুধু বলেন, “নথিভুক্ত চাষিরা বছরের দু’বার ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের বরাদ্দ পান। আমাপানের ক্ষতিপূরণ হিসাবেই বাড়তি একটি কিস্তি দেওয়া হয়েছে।”