রঘুনাথপুরে রামমোহন রায়ের বসতবাটী এখন যে অবস্থায়। ছবি: সঞ্জীব ঘোষ
রাজ্য সরকার তাঁর ভগ্নস্তূপে পরিণত হওয়া বসতবাড়ি এবং তাঁর স্মৃতিতে একসময়ে গড়ে ওঠা মেমোরিয়াল হলকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে ফলক সেঁটেছে গত মে মাসে। কিন্তু ২৫০তম জন্মবর্ষেও রাজা রামমোহন রায়ের জন্মস্থান খানাকুলের রাধানগরকে কেন্দ্র করে রামমোহন অনুরাগীদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মনীষীর জন্মভূমি অবহেলিতই থেকে গিয়েছে বলে আক্ষেপ রামমোহনের স্মৃতি রক্ষার দাবিতে গড়া ওঠা কমিটিগুলির।
গত ২২ মে রামমোহনের ২৫০ তম জন্মজয়ন্তী পূর্তিতে তাঁর জন্মস্থানের দু’টি ক্ষেত্রকে ‘হেরিটেজ’ স্বীকৃতি দিয়ে সে সংক্রান্ত ফলক উন্মোচন করে যান রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য। সে সময় শুভাপ্রসন্ন বলেছিলেন, “পদ্ধতিগত ভাবে এগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের চেষ্টা হবে। পাঠাগার-সহ নানা ক্ষেত্রের উন্নয়নের চেষ্টা হবে।” বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের প্রথম মানুষটির জন্মদিনটি যাতে সরকারি ক্যালেন্ডারে গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়, তা নিয়েও মুখ্যমন্ত্রীকে জানানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন শুভাপ্রসন্ন। কিন্তু এখনও কিছু হয়নি বলে অভিযোগ।
নিজের জন্মস্থানে রামমোহন অবহেলিত বলে দীর্ঘদিনের আক্ষেপ খানাকুল-সহ আরামবাগ মহকুমার বহু মানুষের। জন্মস্থান রাধানগর এবং এক কিলোমিটার তফাতে রঘুনাথপুরে তাঁর বসতবাটীকে কেন্দ্র করে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র তথা হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দানের দাবিকে সামনে রেখে বাম আমল থেকে গঠিত বিভিন্ন কমিটিগুলির বেশ কিছু জোটবদ্ধ হয়ে বছর কয়েক ধরে ‘রাধানগর রামমোহন মেমোরিয়াল অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন’ গঠন করেছে। এ ছাড়া ১০০ বছরে পা দেওয়া রাধানগর পল্লি সমিতি ধারবাহিক ভাবে রামমোহনের স্মৃতি রক্ষার দাবিতে সরব আছে। ২০১৯ সালে গঠিত কলকাতার ‘রামমোহন রিমেমব্রেন্স সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থাও সম্প্রতি ওই সমিতির সঙ্গে শামিল হয়েছে। গত ১৯ নভেম্বর রাধানগরে দু’পক্ষ যৌথ ভাবে রামমোহনের বিলেত যাত্রার দিন পালন করে এবং স্মারক পুস্তিকা প্রকাশ করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর রামমোহন কলকাতা থেকে তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুরের খেজুরি বন্দরে যান। সেখানে ডাকঘরে রাত কাটিয়ে পরের দিন জাহাজে ওঠেন।
‘রাধানগর রামমোহন মেমোরিয়াল অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন’ এবং একই সঙ্গে রাধানগর পল্লি সমিতির সভাপতি, বিশিষ্ট রামমোহন গবেষক পরেশচন্দ্র দাসের আক্ষেপ, “হেরিটেজ ঘোষণার পর একটি অতিথিশালা তৈরি হওয়া ছাড়া অবহেলিতই থেকে গিয়েছে রামমোহনের জন্মস্থান। আমাদের প্রস্তাবগুলির মধ্যে অন্যতম, রামমোহনের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, আরামবাগের মায়াপুর থেকে রাধানগর পর্যন্ত ১২ কিমি রেলপথ এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি থেকে রামমোহন পুরস্কারেরও প্রবর্তন করা। কিন্তু কোনও উদ্যোগ দেখছি না।” একই দাবির কথা বলেছেন রামমোহন গবেষক তথা বিভিন্ন কমিটির পদাধিকারী দেবাশিস শেঠ, বাসুদেব বসু, প্রসূন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।
রামমোহন অনুরাগীদের অভিযোগ, জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ‘রামমোহন মেলা’ হওয়া ছাড়া স্মৃতি সংরক্ষণে বিশেষ কিছু হয়নি। রামমোহনের ব্যবহৃত নানা জিনিস বা তার রেপ্লিকা, জীবনের নানা ঘটনাবলির স্ট্যাচুরূপ রাখার জন্য মিউজিয়ামের দাবি ছিল সে জন্য রঘুনাথপুরে রামমোহনের হাতে লাগানো আমবাগান এলাকায় ভবন নির্মাণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মিউজিয়াম গড়া হয়নি। সর্বোপরি ১৯৬০ সালে সরকারি ভাবে রামমোহন স্মৃতি সংরক্ষণে রাধানগর, রঘুনাথপুর ও নাঙ্গুলপাড়ায় তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির প্রায় ১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হলেও সংরক্ষণের উল্লেখযোগ্যব্যবস্থা হয়নি।
জেলা সভাধিপতি মেহবুব রহমান বলেন, “রামমোহন আমাদের সকলের আবেগের জায়গা। তাঁর বাসভবন-সহ বিভিন্ন স্মৃতি সংরক্ষণে আমরা জেলা পরিষদ থেকে সাধ্যমতো দফায় দফায় কাজ করছি। মনীষীরজন্মভূমির সার্বিক উন্নয়নে হেরিটেজ কমিশনও চিন্তাভাবনা করছে। মুখ্যমন্ত্রীরও নজরে আছে।”