ব্লক কার্যালয়ে গিয়ে বিডিও নীলাদ্রি সরকারকে চকলেট ও ফুল দিচ্ছে শ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা। ছবি: বিশ্বজিৎ মণ্ডল।
জনা দশেক খুদের মধ্যে একটা মেয়ে সাহস করে বলেই ফেলল, ‘‘তুই যাবি না, স্যর’। সাহস পেল অন্যেরাও। তাদেরও একই আব্দার!
ওদের পরিচয়— ইটভাটা শ্রমিকের সন্তান। যাঁর উদ্দেশ্যে আব্দার, তিনি নীলাদ্রি সরকার। বিডিও হিসেবে হুগলির বলাগড় থেকে বদলি হয়ে যাচ্ছেন উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটায়। ‘ওই স্যর আর থাকছেন না’ শুনেই বৃহস্পতিবার এক শিক্ষকের সঙ্গে ছেলেমেয়েগুলো ছুটে এসেছিল ওই সরকারি আধিকারিকের অফিসে। সটান তাঁর চেয়ার ঘেঁষে বলে ফেলেছিল মনের কথা। প্রশাসনিক কর্তার মুখে কথা সরেনি। শুধু বলেন, মাঝেমধ্যেই আসবেন।
নীলাদ্রির সঙ্গে জিরাটের ইটভাটার ওই শিশুদের সম্পর্কের বয়স এক বছরও নয়। তাদের নিয়ে ইটভাটা চত্ত্বরে পাঠশালা চালাচ্ছিল বলাগড় কলেজ। গত পয়লা জানুয়ারি ধুলো ওড়া জমিতে তাদের স্পোর্টস দেখতে গিয়েছিলেন বিডিও। পাঠশালার হোতা, কলেজ শিক্ষক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে সেই দিনই ঠিক করেন, ওই সব পরিযায়ী পরিবারের সন্তানদের স্কুলের আঙিনায় আনবেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর মধ্যস্থতায় শ’খানেক ছেলেমেয়ে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়। জিরাটে, ব্লকের অন্যত্রও। স্কুলে তারা মিড-ডে মিল খায়। পোশাক, বইপত্র, ব্যাগ পেয়েছে। উলোঝুলোচুল আর ধুলোমাখা গা উধাও।
তাদের নিয়ে সম্প্রতি তথ্যচিত্র বানিয়েছে প্রশাসন।
পার্থ বলেন, ‘‘বিডিওর নিজের ছেলে ছোট। প্রথম দিন থেকেই ইটভাটার বাচ্চাদের সঙ্গে কেমন একটা টান হয়ে গেল লোকটার। শিশুগুলোও ওঁর কাছে স্বচ্ছন্দ। বাচ্চাগুলো বিডিও কথার অর্থ বোঝে না। ভালাবাসার মানে বোঝে। বৃহস্পতিবার ওদের কথায় বিডিও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন।’’ তাঁদের ছেলেমেয়েদের প্রিয় ‘স্যর’ চলে যান, চান না পরিযায়ী শ্রমিকেরাও।
ষোলো বছর আগে হরিপালের জামাইবাটী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সন্দীপ সিংহের বদলির ছাড়পত্র এসেছিল তাঁর বাড়ির কাছের স্কুলে। খবর পেয়েই স্কুল ঘিরে ফেলেছিল ছাত্রছাত্রীরা। সঙ্গে বাবা-মায়েরা। তাঁর যাওয়া চলবে না। শেওড়াফুলির একটি স্কুল থেকে ২০১৯ সালে শ্রীরামপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হয়ে আসার আগে একই অভিজ্ঞতা হয় আইভি সরকারের। ভিন্ রাজ্য থেকে আসা শ্রমিকদের সন্তানদের সঙ্গে বিডিও-র সখ্য শুনে দু’জনেরই প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই
অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার নয়। অমূল্য উপহার।’’
সন্দীপ বলেন, ‘‘আমি যে স্কুলের ছাত্র, সেখানেই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসার কাছে হেরে যাই। মা বলেছিলেন, আমি যেন ওদের চোখের জলের মূল্য দিই। সেটাই করেছিলাম। প্রশাসনিক পদে থেকে বিডিওকে যেতেই হবে। তবে শিশুদের প্রতি ওঁর ভালবাসা নিশ্চয়ই অটুট থাকবে।’’ আইভির কথায়, ‘‘প্রান্তিক শ্রেণির ওই শিশুদের সামাজিক যা অবস্থান, তাতে কারও কাছে আব্দারের সুযোগই মেলে না ওদের। ভালবাসার মানুষ চলে যাচ্ছেন, এটা বুঝেই ওদের মন কেঁদেছে।’’
বৃহস্পতিবার চকলেটে শিশুগুলির মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন বিডিও। শুক্রবার তাঁর সৌজন্যে বিরিয়ানি খেল জনা পঁচিশ বাচ্চা। তাও দল বেঁধে রেস্তরাঁয় গিয়ে। সেটাও প্রথম।
তথ্য সহায়তা: বিশ্বজিৎ মণ্ডল