উলুবেড়িয়া পুরসভার ডাম্পিং গ্রাউন্ডের আবর্জনা থেকে প্লাস্টিকের বোতল-সহ নানা সামগ্রী কুড়োচ্ছে কিশোরেরা। নিজস্ব চিত্র
ওরা এখনও ভীত-সন্ত্রস্ত।
হবে না-ই কেন! কতই বা বয়স ওদের! কারও ১২, কারও ১০, কারও বা আরও কম। ভাগাড় থেকে প্লাস্টিকের বোতল, ছিপি, লোহার টুকরো, ছেঁড়া কাপড় ইত্যাদি কুড়িয়ে ওদের দিন চলে। বুধবারেও কুড়োচ্ছিল। কিন্তু অতি সন্তর্পণে। না জানি, আবার কোন ‘বাচ্চার দেহ’ মেলে!
সামিরুল, মানোয়ার, রাকিবুল, জাকিরদের জন্যই মঙ্গলবার উলুবেড়িয়ার বাণীতবলায় পুরসভার ভাগাড় থেকে ১৭টি মৃত মানবভ্রূণ মিলেছে। ওরা অবশ্য ভ্রূণ কাকে বলে জানে না। ওরা জানে, ওগুলো ‘বাচ্চার দেহ’। দেখে ওদের হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল।
ওই ভাগাড়ের পাশের বস্তিতেই সামিরুলদের বাস। যে কোনও দিন সকালে ভাগাড়ে গেলেই দেখা মিলবে ৩০-৪০ জন কিশোরের। উলুবেড়িয়া পুরসভার ৩২টি ওয়ার্ডের আবর্জনা গাড়ি করে নিয়ে এসে ফেলা হয় এই ভাগাড়ে। সকাল থেকে উঠেই ওই কিশোররা দৌড়তে থাকে আবর্জনার গাড়ির পিছনে। প্রতিদিন ভাগাড় থেকে নানা জিনিসপত্র কুড়িয়ে এনে ওরা বিক্রি করে। রোজগার হয় ১৫০-২০০ টাকা। তা দিয়ে সংসার চলে।
ছেলেগুলোর কেউই প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি টপকায়নি। কেউ কেউ আবার স্কুলের মুখও দেখেনি। সামিরুল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। লকডাউনের পর আর স্কুলে যায়নি। আরও কম বয়সে তার বাবা-মা পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। মাসির কাছে থাকে ছেলেটি।
সামিরুল জানায়, মঙ্গলবার সকালে আবর্জনা ঘাঁটতে গিয়ে তারা দেখে একাধিক প্লাস্টিকের জারে মধ্যে একাধিক ‘বাচ্চার দেহ’। সবমিলিয়ে ১৭টা। ভয়ে তারা চিৎকার করে ওঠে। ছুটে আসেন এলাকার লোকজন। সামিরুলের কথায়, ‘‘প্রথমে তিনটে বস্তার মধ্যে অতগুলো প্লাস্টিকের জার দেখে ভেবেছিলাম, অনেক টাকা রোজগার হবে। বস্তার মুখ খুলে ঢালতেই দেখি জারে বাচ্চার দেহ। তাদের হাত-পা, মাথা আছে। পাড়ার বড়রা বলছিল, ওগুলো নাকি মানবভ্রূণ!’’
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে পুলিশ গিয়ে ভ্রূণগুলি উদ্ধার করে অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে চলে যায়। এরপরে কী হবে সামিরুলরা জানে না। কিশোরদের মনে একটাই প্রশ্ন, ‘‘এতগুলো বাচ্চা কী করে মারা গেল! কারাই বা ফেলে দিয়ে গেল?’’
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া ১৭টি ভ্রূণ প্রায় মানবদেহের আকার নিয়ে নিয়েছিল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আইনসঙ্গত গর্ভপাতের নির্দিষ্ট সময়সীমা (২০ সপ্তাহ) পার হওয়ার পরে গর্ভপাত করানো হয়েছিল। এর পিছনে কোনও দালাল-চক্র কাজ করছে বলে উলুবেড়িয়ার চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন।
তদন্তে নেমেছে পুলিশ, জেলা স্বাস্থ্য দফতর এবং পুরসভা। উলুবেড়িয়া শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নার্সিংহোম বা কোনও বেসরকারি হাসপাতালের কারও সঙ্গে দালাল-চক্রের যোগসাজশে এই ভ্রূণহত্যা কি না, তা সময় বলবে। সামিরুলরা শুধু এই ‘বেআইনি কারবার’-এর পর্দাটা সরিয়ে দিল।