তারকেশ্বর মন্দির। —নিজস্ব চিত্র।
প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তীর্থ শহর তারকেশ্বর। ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানি ১৮৮৫ সালে শেওড়াফুলি থেকে তারকেশ্বর লাইনের সূচনা করে। তার আগেও অগণিত তীর্থযাত্রী গঙ্গা থেকে জল নিয়ে তারকেশ্বরে আসতেন। পরবর্তী কালে রেলে আসা আরও সহজ হয়। তখন তারকেশ্বর ছিল ভাটা মৌজার অন্তর্গত। বেনা বনের জঙ্গল, জলাভূমি পরিপূর্ণ অঞ্চল। শ্বাপদ সংকুল ভূমি, শ্মশান ভূমি। আশপাশের গ্রামবাসীরা শবদাহ করতে আসতেন। মন্দির সন্নিকটে ছিল কিছু সাধুসন্তদের কুঠিয়া। সাধুদের কিছু সমাধি মন্দির।সাধুরা শিব উপাসনা করতেন।
শোনা যায়, অষ্টদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুদাস নামে এক ব্যক্তি সুদূর উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা থেকে তারকেশ্বর আসেন। পার্শবর্তী রামনগর গ্রামে বসবাস করতেন। তাঁর গোশালার গরুরা এই বনভূমিতে চারণ করত। অলৌকিক ভাবে কপিলা নামক একটি গরুর বাট থেকে একটি প্রস্থ শীলার উপরে দুধ বর্ষণ হতে দেখা যায়। পরে উনি এবং ওঁর ভাই ভাড়ামল্ল স্বপ্নাদেশ পান।মহাদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। সেই সময় সুদূর গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাতট পরিক্রমা কারি আচার্য শঙ্কর সৃষ্ট সাধুরা আসেন। দেবভূমিতে উপাসনা করতে। মহন্ত হন
মায়াগিরি ধুম্রপান।
যুগ পরিবর্তন হতে থাকে। বিভিন্ন রাজন্যবর্গ যথা বর্ধমান নরেশ, দারভাঙা নরেশ প্রমুখ হিন্দু রাজাদের বদান্যতায় মন্দির পার্শ্ববর্তী স্থানে আগত যাত্রীদের সুবিধার্থে পুকুর, ফুলের বাগান, গোশালা, পরবর্তী কালে রাজবাড়ি অর্থাৎ কিনা মোহন্ত মহারাজের নিবাস নির্মিত হয়। গিরি সাধকরা পরম্পরা অনুসারে উপাসক ছিলেন এই দেবভূমির। সতীশ গিরি মহন্তের আমলে মন্দিরের সেবা ব্যবস্থার খুবই উন্নতি হয়। সেই সময় পার্শ্ববর্তী এলাকা গ্রাম থেকে বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন পেশার তাগিদে তারকেশ্বরে বসতি গড়ে তুলতে শুরু করেন। মন্দির সংলগ্ন স্থানে নারায়ণ ও কালী মন্দির নির্মিত হয়। নাটমন্দির ও দুধপুকুরের প্রভূত সংস্কার হয়। জনবসতি বাড়তে থাকে। সমগ্র বাংলার বহু মনীষীর পদধূলি পরে তারকেশ্বরে। শোনা যায় সারদাদেবী একাধিক বার ব্রত করতে তারকেশ্বর এসেছেন। তীর্থযাত্রীরা দূরারোগ্য ব্যধি দূর করতে এবং সন্তানের কামনায় পুজো দিতে আসেন।
বাঁক কাঁধে তারকেশ্বরের পথে। —নিজস্ব চিত্র।
সেই সময় তারকেশ্বরের মহন্ত ব্রিটিশদের কাছ থেকে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যুগের অসহযোগ আন্দোলনের সময়। ইতিহাস বলে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তারকেশ্বরে এসে আন্দোলন করে গিয়েছেন। সেই সময়ে মহন্তের কিছু ত্রুটির জন্য আদালত তারকেশ্বর মন্দিরে রিসিভার বসিয়ে দেয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বনামধন্য আইনজীবী অমূল্যচন্দ্র ভাদুড়িকে। তিনি তারকেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় তৈরি করিয়েছিলেন। সময়টা ছিল স্বাধীনতার ঠিক আগে।
একটি দেবস্থানের অধ্যক্ষ একজন সন্ন্যাসী হওয়া সঙ্গত মনে করে শ্রীমৎ দন্ডিস্বামী জগন্নাথ আশ্রম। স্বামীজি মঠাধিশ হন। তারকেশ্বর এস্টেটের তত্ত্বাবধানে অছি হস্তান্তর হয়। তার পরবর্তী সময়ে তার শিষ্য ভারত বিখ্যাত সাধক শ্রীমৎ দন্ডিস্বামী ঋষিকেশ আশ্রম এর সময় সমগ্র ভারতের বিশিষ্ট পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সমাগম হয় তারকেশ্বরে। তারকেশ্বরে সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় চতুষ্পাঠী গড়ে ওঠে। জ্ঞানমার্গ ও বেদ পাঠের অধ্যয়নে কাশি তুল্য স্থান হয় তারকেশ্বর। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গের দাবিতে হিন্দু মহাসভার সম্মেলন হয় তারকেশ্বর রাজবাড়ির মাঠে। পৌরহিত্য করেন শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়।সে এক স্বর্ণোজ্বল ঘটনা।
১৯৫৮-৫৯ সালে তারকেশ্বরে রেলের ইলেকট্রিফিকেশান হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভূত উন্নত হয়। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধি পায়। গ্রামীণ হাসপাতাল নির্মাণ হয়। জনবসতি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বিভিন্ন বিদ্যালয় তৈরি হয়। রামকৃষ্ণ মঠের ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী জ্যোতি চৈতন্যের উদ্যোগে তারকেশ্বরের ডিগ্রি কলেজ ও মহাবিদ্যালয় নির্মাণ হয়। মন্দিরকেন্দ্রিক শহরে একাধিক ধর্মশালা, যাত্রী নিবাস নির্মাণ হয়। পরবর্তী কালে পুরসভার অতিথিশালা ও সরকারি নিবাস তৈরি হয়। জ্ঞান শিক্ষন ব্যতিরেকে বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র তারকেশ্বরে গরে ওঠে। নগরায়নের চাপ বাড়তে থাকে।
১৯৭৫ সালে তদানীন্তন বিধায়ক বলাইচন্দ্র শেঠের উদ্যোগে তারকেশ্বর পুরসভা গঠিত হয়। পরবর্তী কালে রাম চট্টোপাধ্যায়, প্রতীম চট্টোপাধ্যায় ও রচপাল সিংহ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রিসভায় আসন অলঙ্কৃত করেন তারকেশ্বর থেকে। দিনে দিনে তারকেশ্বরের পরিবর্তন হতে থাকে। তারকেশ্বরের দুধপুকুরের সংস্কার নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। এর সংস্কার আদালতের তত্ত্বাবধানে করা গিয়েছে। কিন্তু যে স্থান অতি পরিবেশবান্ধব ছিল, সেখানে জমি মাফিয়াদের হস্তক্ষেপে নির্বিচারে গাছ কাটা, জলাভূমি ভরাট করা, নিকাশি নালা ও দেবত্তর সম্পত্তির উপরে নির্মাণ কাজে শহরের নাগরিকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দিয়েছে। এখনও নিকাশি নালার মাস্টার প্ল্যান করে ফেলার সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
একটাই গ্রামীণ হাসপাতাল। এর বাইরে আর কোনও হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। চিকিৎসা বা হাসপাতালের মানোন্নয়ন সেই অর্থে হয়নি। প্রস্তাবিত মেডিক্যাল কলেজও হয়নি। তারকেশ্বরের ২৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনও আধুনিক ব্যবস্থা সম্পন্ন হাসপাতাল বা নার্সিংহোম নেই।
শৈব ক্ষেত্রে তারকেশ্বর উন্নয়ন পর্যদ তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন পর্যদ যে তৈরি হয়েছে, সেটা অনেকটা আলো-আঁধারি খেলার মতো। সমস্ত ভারত থেকে তীর্থযাত্রীরা আসেন তারকেশ্বরে। তাঁদের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়ে গিয়েছে। বছরে দু’টি মেলা— শ্রাবণ মাসে শ্রাবণী মেলা এবং চৈত্র মাসে গাজন মেলা ছাড়াও শিবরাত্রি উৎসব হয়। শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবার থেকে শনিবার শেওড়াফুলির নিমাই তীর্থ ঘাট থেকে গঙ্গার জল তুলে পদব্রজে তারকেশ্বরে নিয়ে আসেন তীর্থযাত্রীরা। গাজনের সময় ভক্তরা আসেন এক মাস ধরে ধর্মাচরণ করেন। তাঁদের থাকা-সহ উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাব দেখা যায়। জলযাত্রী এবং তীর্থযাত্রীদের মন্দির দর্শনে অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রে যে ধরনের ব্যবস্থা আছে এখানেও সরকারি উদ্যোগে করা উচিত। সৌন্দর্যায়নের ক্ষেত্রে ইদানীং মন্দিরকে আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। তারকেশ্বরে একটিমাত্র শিশু উদ্যান রয়েছে।
ক্রীড়া ক্ষেত্রে তারকেশ্বরের ভাল ভূমিকা আছে। এখান থেকে অ্যাথলেটিক্স ভলিবলে বাংলা তথা দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন অনেকেই। বর্তমানে কবাডি মার্শাল আর্ট-সহ সমস্ত খেলা চলছে বলতে গেলে নিজেদের উদ্যোগে।
তারকেশ্বরে দু’টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল। ১৯৭৭ সালে টলিউডের সিনেমা ‘বাবা তারকনাথ’ সুপারহিট হয়। রাজ্যের বিভিন্ন সিনেমা হলে সেই সময় ‘বাবা তারকনাথ’ প্রদর্শিত হয়েছে। তারকেশ্বরের সিনেমা হলেও। বর্তমান সময়ে কোনও প্রেক্ষাগৃহ আর নেই তারকেশ্বরে। তারকেশ্বরবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবি একটা ভাল প্রেক্ষাগৃহের।
তীর্থ কেন্দ্রিক শহরে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় একাধিক কর্মোদ্যোগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তারকেশ্বরে সেটা হয়নি। পুঁথি সংগ্রহশালা ধর্মীয় গ্রন্থাগার এবং তারকেশ্বর ইতিহাস সম্মানিত সংগ্রহশালা তৈরির দাবি পূরণ হয়নি। তারকেশ্বর মূলত কৃষি প্রধান এলাকা এখানে চন্দ্রমুখী আলু উৎকৃষ্ট। ধান চাষও ভাল হয়। কৃষি গবেষণার স্থান তারকেশ্বরে হতে পারত যা হয়নি। কৃষি বিপণনের ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। শুধু কয়েকটি হিমঘর তৈরি হয়েছে আর মালগাড়ির রেক মাঝেমধ্যে বাইরে আলু নিয়ে যায়।
বর্তমানে তারকেশ্বর পুরসভায় ১৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। ৪০ হাজার মানুষের বাস। প্রায় ৬০ শতাংশ স্থানে স্থায়ী পয়ঃপ্রণালী নেই। আলোকস্তম্ভ বসানো হয়েছে কয়েকটি গেট নির্মাণ হয়েছে। বাঙালি উদ্যোগপতিদের উদ্যোগে পরাধীন ভারতে প্রথম রেল প্রকল্প অর্থাৎ বিপিআর রেল (বেঙ্গল প্রভিন্স রেলওয়ে) প্রথম তারকেশ্বরেই শুরু হয়। এই রেল সেই সময় চলত তারকেশ্বর হয়ে মগরা থেকে ত্রিবেণী ঘাট পর্যন্ত। ১৯৫২ সালে সেই রেল উঠে যায়। পরবর্তী কালে বিভিন্ন সরকার সমীক্ষা চালিয়েছে, কিন্তু রেল চালু হয়নি।
১৯৯২ সালে পুরনো বাসস্ট্যান্ড তৈরি হয়। ২০১৮ সালে তার পাশেই দ্বিতীয় বাস টার্মিনাল তৈরি হয়েছে। যেখান থেকে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছে। অন্যান্য শহরের মতোই তারকেশ্বরে নগরায়নের চাপ বাড়ছে। নতুন নতুন আবাসন গড়ে উঠছে। নতুন বসতি গড়ে উঠছে। তাই প্রয়োজন মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা। পরিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব রয়েছে। শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার আরও উন্নতি করা প্রয়োজন। শহরে রেল গেটে যানজট এড়াতে উড়াল পুলেরও প্রয়োজন। তারকেশ্বর যে হেতু প্রাচীন জনপদ এবং অবশ্যই তীর্থ ক্ষেত্র, তাই দিন দিন এখনে মানুষের আনাগোনা বাড়বে। স্থায়ী বসতি গড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। তাই শহরকে বাড়াতে হবে। আর আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে হবে। তবেই পুর নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ বাড়বে আর বাইরে থেকে আসা তীর্থ যাত্রীরাও তারকেশ্বরে বার বার ফিরে আসবেন।