সন্দেশখালির আতঙ্ক: বাম আমলে বিঘা প্রতি তোলা নিত শাজাহান, তৃণমূল আমলে কাঠা প্রতি

সরবেড়িয়ার এক প্রবীণ তৃণমূল নেতা জানালেন, মেছো ভেড়ি থেকে শুরু করে ইট ভাটা— সর্বত্রই তোলা আদায়ে নেমে পড়ে শাজাহান বাহিনী।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৯ ০১:৪১
Share:

শাজাহান শেখ। —ফাইল চিত্র

সন্দেশখালির নোনা জলে ফলে আছে ‘সোনা’। সেই ‘সোনা’ হল মাছ। ভেড়ির মাছ চাষই এখানকার মূল জীবিকা। এলাকার লোকেরা বলেন জলকর বা ঘেড়ি। সেখানে যে চিংড়ি, ভেটকি, পার্শে চাষ হয়, তা যায় কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। ভেড়িকে ঘিরেই নানান ব্যবসা বসিরহাট মহকুমার আনাচে কানাচে। অনেকেই বলেন, সুন্দরবনের এই এলাকায় বাতাসে টাকা ওড়ে। ঠিকঠাক ধরতে পারলেই হল।

Advertisement

সেই টাকা ধরার কৌশলটাই শিখে ফেলেছিলেন শাজাহান, বলছেন তাঁর দল তৃণমূলেরই অনেকে।

সরবেড়িয়ার এক প্রবীণ তৃণমূল নেতা জানালেন, মেছো ভেড়ি থেকে শুরু করে ইট ভাটা— সর্বত্রই তোলা আদায়ে নেমে পড়ে শাজাহান বাহিনী। বাম আমলে এই শাজাহান বাহিনীই জলকরে বিঘা প্রতি তোলা আদায় করত। তৃণমূল আমলে তা দাঁড়াল কাঠা প্রতি তোলার হিসেবে। এলাকার কোনও জলকর শাজাহানের অনুমতি ছাড়া নিলাম হত না। নিলাম পরিচালনা করত তাঁর লোকেরাই। ফলে কে কোন জমি কত দিনের জন্য ইজারা পেল, তা লেখা থাকত শাজাহানের লোকজনের কাছেই।

Advertisement

ফাল্গুন-চৈত্র মাসে জলকর চুক্তির আগে মালিক পক্ষের হাতে ইজারার প্রথম কিস্তির টাকা তুলে দিতে হত। এক মাছচাষি বলেন, ‘‘আগে নিয়ম ছিল, ইজারাদারই শাজাহান বাহিনীকে তোলা দেবে। কিন্তু বছর কয়েক ধরে নতুন নিয়ম শাজাহানের। ইজারাদারদের পাশাপাশি তারা চাষিদের কাছ থেকেও তোলা আদায় চালু করে।’’ আর টাকা না দিলে? এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, চাষিরা টাকা দিতে না চাইলে তাঁদের ইজারার টাকা বন্ধ করে দেওয়া হত। আর ইজারাদার না দিতে চাইলে, তাঁকে জলকরে নামতে দিত না শাজাহান বাহিনীর লোকেরা। এক ভেড়ি মালিক জানালেন, শাজাহান বাহিনী এলাকায় এমন ত্রাস তৈরি করেছিল, তাঁকে টাকা না দেওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারত না। শোনা যায়, ক’দিন আগে পর্যন্তও তাঁর ছেলেরা কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র গুঁজে পাড়ায় টহল দিত। তোলা আদায়ের পাশাপাশি নিজেও ভেড়ির কারবার শুরু করেন শাজাহান। প্রথমে ইজারা নিয়ে, পরে জমি কিনে। এখন ভেড়ির পাশাপাশি মাছের আড়তও রয়েছে তাঁর। এলাকার এক প্রবীণ শিক্ষক শোনালেন তাঁর এক আত্মীয়ের অভিজ্ঞতা। এলাকায় সাধারণত দুই বা তিন বছরের জন্য জমি ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু একজনের জমি শাজাহান নিজে লিজে নেন। তাতে কোনও সময়ের উল্লেখ না করেই সই করিয়ে নেওয়া হয়। পরে যখন তাঁদের হাতে চুক্তির কাগজ দেওয়া হয়, তাতে লেখা ছিল, ২০ বছরের জন্য ওই জমি শাজাহানকে তাঁরা ইজারা দিয়েছেন। প্রতিবাদ করেছিল পরিবারটি। অভিযোগ, হুমকি দিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু মেছো ভেড়িই নয়, এলাকায় প্রচুর ইটভাটা রয়েছে। অভিযোগ, সেখানেও তোলার বন্দোবস্ত রয়েছে শাজাহানের।

ভেড়ি এলাকায় তোলার ইতিহাস বাম আমলেও চলত বলে অভিযোগ। সেই চাপ ইদানীং বেড়েছিল বলে জানাচ্ছেন অনেকেই। এলাকার এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘ওরা গব্বর সিংহের দলের মতো। যেখান থেকে যা ইচ্ছা তুলে নিয়ে চলে যায়। বাধা দেওয়ার সাহস কারও নেই।’’ অভিযোগ, বছর দেড়েক আগে স্থানীয় কলেজের ভোটও কব্জা করে রেখেছিল শাজাহানের বাহিনী। ভোটের দিন দু’য়েক আগে থেকে তারা কলেজের পাশে ডেরা বেঁধে ছিল। সেই দু’দিন ন্যাজাট বাজারের দোকানে দোকানে ঢুকে চাল-ডাল-মাছ-মাংস-ডিম-মিষ্টি, যা ইচ্ছা তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। ভোটের দিন কলেজ ঢোকার সব রাস্তায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে টহল দেয় শাজাহানের লোকেরা। ফলে কেউ আর কলেজে যাওয়ার সাহস করেনি। দিন শেষে রাস্তার ঘুমন্ত কুকুরকে গুলি করে মেরে ভোটে জেতার উল্লাস করেছিল সেই বাহিনী।

এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে সন্দেশখালির ভেড়ি এলাকার রাজনীতিতে খুনোখুনি নতুন ঘটনা নয়। এ বার লোকসভা ভোটে এলাকায় বিজেপির শক্তি বাড়ার ফলে অশান্তির আশঙ্কা ছিলই। ভাঙিপাড়ায় তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা সেই আশঙ্কাকেই সত্যি প্রমাণ করল। এত কিছুর পরে কি শাজাহান আগের প্রতাপ ধরে রাখতে পারবেন? পুলিশ কি কোনও ব্যবস্থাই নেবে না? প্রশ্ন ঘুরছে সন্দেশখালির বাতাসে।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement