এই ধরনের খবরের ক্ষেত্রে আসল ছবি প্রকাশে আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকে। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
কাজ পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা— ছেলে, মেয়ে যে-ই হোক, বয়স হতে হবে ৯ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। কাজ বলতে বাড়ির এক বয়স্কের দেখাশোনা করা! বয়স বেশি হলেও সঙ্গে ১০ বছরের মেয়ে থাকায় এই কাজই সহজে পেয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে কলকাতায় আসা এক স্বামীহীনা মহিলা। কিন্তু ‘বড় বাড়ির’ কাজের সেই অভিজ্ঞতা দুঃস্বপ্নের চেহারা নেয় দ্রুত! এক দিন নিখোঁজ হয়ে যায় মহিলার নাবালিকা মেয়ে। থানা-পুলিশ হয়। তবে সেই নাবালিকাকে উদ্ধারের পরে পুলিশ দেখে, তার সারা গায়ে সিগারেটের ছেঁকার দাগ। বাদ নেই উরু, মুখের নানা জায়গাও।
সে পালিয়েছিল কেন? পুলিশকে নাবালিকা জানায়, অত্যাচার এড়াতেই সে পালিয়েছে। মা’কে বলে লাভ হবে না বুঝেই তার এই পদক্ষেপ। নাবালিকা বলেছিল, ‘পালা করে বাবুর (ওই বয়স্কের) ঘরে যেতে হত। কথা না শুনলে সিগারেটের ছেঁকা দেওয়া হত। বহু বার কথা শোনার পরেও জ্বলন্ত সিগারেট গায়ে ঘষে দেওয়া হয়েছে। হুইলচেয়ারে বসেই নানা রকম অত্যাচার করতেন বাবু।’
কিন্তু এক নামী ব্যবসায়ী পরিবারের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে তদন্ত বেশি দূর এগোয়নি। যে থানায় মামলাটি হয়েছিল, সেখান থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে যান তদন্তকারী অফিসার। তিনি শুধু বললেন, ‘‘দশ-পনেরোটি বাচ্চা দেখেছিলাম ওই বিরাট বাড়ির উঁচু দেওয়ালের ভিতরে। বিহার আর ঝাড়খণ্ড থেকে কোনও চক্রের মাধ্যমে এসেছে। প্রায় সকলের গায়েই অত্যাচারের দাগ।’’ সিগারেটের ছেঁকা? আর কথা এগোতে চান
না অফিসার।
খোঁজ করতেই জানা গেল, শহরের নানা স্তরের মানুষের মধ্যে ঘটে চলেছে এমন অপরাধ। রীতিমতো বরাত দিয়ে জেলা, ভিন্ রাজ্য থেকে আনানো হচ্ছে শিশু। তাদের যৌন নিগ্রহ, ধর্ষণ তো চলেই, তুলে রাখা হচ্ছে সেই সব মুহূর্তের ভিডিয়ো-অডিয়োও। এরপর তা বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। কখনও সমাজমাধ্যমে এমন ভিডিয়োর দর উঠছে লক্ষাধিক টাকা। আবার ‘ডার্ক ওয়েবের’ মতো গোপন ইন্টারনেট মাধ্যমে সেগুলি বিকিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার টাকায়। এ নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কলকাতা শাখার কর্মী বললেন, ‘‘বিরাট চক্র কাজ করছে। লকডাউনের পর থেকে মারাত্মক ভাবে বেড়েছে সবটা। পিডোফাইলদের জন্য শিশুর জোগান দেওয়া শুধু নয়, ব্যবসায়িক স্বার্থে ভিডিয়ো তুলে বিক্রি করার জন্যও নির্মম অত্যাচার চলছে।’’
মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘পরিচয় গোপন রেখে সবটা করা সম্ভব বলে সমাজমাধ্যমে বাড়ছে শিশু-অত্যাচার। সব ক্ষেত্রেই পিডোফাইল-রা করছে, সেটা না-ও হতে পারে। কিন্তু ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে যদি দেখা যায়, শিশু পর্নোগ্রাফির উপর অত্যধিক আকর্ষণ রয়েছে, তা হলে বুঝতে হবে পিডোফিলিয়ার লক্ষণ। সমাজের ধারণা রয়েছে, পুরুষেরাই শুধু পিডোফাইল হয়। এটা ঠিক নয়। সামাজিক কাঠামোগত দিক থেকে যেহেতু এখনও পুরুষের ক্ষমতা বেশি, তাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সামনে আসে বেশি। এক জন মহিলাও সমান ভাবে শিশুর যৌন অত্যাচারে লিপ্ত হতে পারে।’’
‘চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ’ (ক্রাই) এবং ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেড চিলড্রেন’-এর (এনসিএমইসি) সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অনলাইনে শিশুদের উপর যৌন অত্যাচারের ঘটনায় এই মুহূর্তে ভারত বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। তার পরে তাইল্যান্ড। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র (এনসিআরবি) রিপোর্ট, ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে শিশু যৌন অত্যাচারের সম্মুখীন হয়। নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের সমীক্ষায় আবার দেখা গিয়েছে, ভারতীয় শিশুদের মধ্যে ৬৮ শতাংশই কখনও না কখনও যৌন অত্যাচারের শিকার হয়েছে।
এই রাজ্যের পরিস্থিতিও উদ্বেগের। এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী, শিশু অত্যাচারের ঘটনায় দেশের মধ্যে প্রথমে রয়েছে দিল্লি। এর পরেই মহারাষ্ট্র, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত লকডাউন এবং তার পরবর্তী পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে অনলাইন মাধ্যমে শিশুদের উপর যৌন অত্যাচারের অভিযোগ জমা পড়ার হার তার আগের পাঁচ বছরের তুলনায় ৭৯ শতাংশ বেড়েছে বলে রাজ্য পুলিশ সূত্রের দাবি।
লালবাজারের এক পুলিশকর্তার দাবি, ঘরছাড়া হয়ে যায় যে শিশুরা, তাদের এই চক্রের খপ্পরে পড়ার সংখ্যা বেশি। কেউ হয়তো পড়াশোনা ভাল লাগছে না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। কেউ বাবা-মায়ের বকুনি শুনে বেরিয়ে এসেছে। এরপর মাথা গোঁজার ঠাঁই, বন্ধু বা ভালবাসা পাওয়ার হাতছানি, তিরস্কার না শোনা এবং দু’বেলা খাবার পাবে ভেবে কারও না কারও দ্বারা প্রভাবিত হয় তারা। যে প্রভাবিত করছে, সে দালাল হতে পারে। খুব সহজেই পাচার হয়ে যেতে পারে শিশুটি। বহু ক্ষেত্রেই শিশুর ঠিকানা যৌনপল্লি নয়তো কোনও পিডোফাইল পুরুষ বা মহিলার বাড়ি হয়ে দাঁড়ায়। পরিচারক বা পরিচারিকার কাজের নামে চলতে থাকে অত্যাচার। (চলবে)