MLA's mysterious death

বিধায়ক-মৃত্যুতে উত্তরবঙ্গ বন্‌ধ ডাকল বিজেপি, তৃণমূল বলল লাশের রাজনীতি

মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ বন্‌ধের ডাক দিলেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২০ ২০:১১
Share:

হেমতাবাদে বিধায়ক মৃত্যুতে তীব্র আক্রমণের রাস্তায় হেঁটেই রাজ্য প্রশাসনের উপরে চাপ বাড়াচ্ছে বিজেপি। নিজস্ব চিত্র

বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরবর্তী একটা দোকানের বারান্দায় যাঁর ঝুলন্ত মৃতদেহ দেখা গেল সোমবার সকালে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিধায়ক। কিন্তু রাজনৈতিক উত্তাপ রাজ্যের সীমানার মধ্যে আটকে থাকল না। বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব তীব্র আক্রমণে নামলেন এ দিন সকাল থেকে। হেমতাবাদের বিধায়কের রহস্যমৃত্যু নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল গোটা দেশে। রাজ্য বিজেপির সুর আরও কয়েক পর্দা চড়া। কলকাতায় প্রতিবাদ মিছিল, জেলায় জেলায় বিক্ষোভ তো শুরু হলই। মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ বন্‌ধের ডাক দিলেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। সিপিএম এবং কংগ্রেসও ‘ আত্মহত্যা’ তত্ত্বে বিশ্বাস রাখতে নারাজ। তবে সব অভিযোগ নস্যাৎ করে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কটাক্ষ, ‘‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়!’’

Advertisement

সোমবার সকাল হতে না হতেই দুঃসংবাদ এসেছিল উত্তরবঙ্গ থেকে। হেমতাবাদের বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়ের ঝুলন্ত মৃতদেহের ছবি সোশ্যাল মিডিয়া মারফৎ হু হু করে ছড়াতে শুরু করে। রায়গঞ্জের পুলিশ সুপার জানান, তাঁদের প্রাথমিক ধারণা, এটি আত্মহত্যা। দেবেন্দ্রনাথ রায়ের পরনে যে জামা ছিল, তার পকেট থেকে সুইসাইড নোট মিলছে বলেও পুলিশ জানায়। কিন্তু পুলিশের বক্তব্য নস্যাৎ করে বিজেপি তোপ দাগতে শুরু করে। বিধায়কের দেহ যে ভাবে ঝুলছিল এবং একটা হাত যে ভাবে বাঁধা অবস্থায় মুখের সামনে ছিল, সেই ছবি দেখিয়ে বিজেপি প্রশ্ন তোলে, হাত বেঁধে কেউ গলায় দড়ি দিতে পারেন কী ভাবে? বাড়ি থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে গিয়ে একটি দোকানের বারান্দা থেকেই বা আত্মহত্যা করতে যাবেন কেন দেবেন্দ্রনাথ রায়? প্রশ্ন তোলেন দিলীপ ঘোষ।

তবে দিলীপ ঘোষের এই বয়ান আসার অনেক আগেই অবশ্য হইচই শুরু করে দিয়েছিল দিল্লি। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডা টুইটারে তীব্র আক্রমণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে। তিনি লেখেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের হেমতাবাদের বিজেপি বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রাথের সম্ভাব্য জঘন্য হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং নিন্দনীয়।’’ এতেই থামেননি নড্ডা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই এবং ‘গুন্ডারাজ’ চলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রায় একই মন্তব্য করেন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষও। নিজের টুইটে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ট্যাগ করে তিনি ‘গুন্ডারাজ’-এর অভিযোগ তোলেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: বিধায়ক মৃত্যু: রাজ্য সিবিআই দাবি উড়িয়ে তদন্তভার দিল সিআইডিকে

নড্ডা এবং সন্তোষের মতো সর্বোচ্চ স্তরের দুই নেতা হইচই শুরু করায় গোটা দেশ থেকে প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে বিধায়কের রহস্যমৃত্যু নিয়ে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় থেকে কনিষ্ঠতম বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য— টুইটারে আক্রমণের বন্যা বইতে শুরু করে। সকাল ১১টা নাগাদ কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে দিলীপ ঘোষ অভিযোগ করেন, দেবেন্দ্রনাথ রায়ের মৃত্যু মোটেই আত্মহত্যা নয়। তাঁকে রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে বলে দিলীপ দাবি করেন। পরিচিতরাই এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ওই এলাকার এক তৃণমূল যুবনেতা এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন বলে রাজ্য বিজেপির সভাপতি অভিযোগ করেন।

আরও পড়ুন: ঝুলন্ত বিধায়কের পকেটে মিলেছে সুইসাইড নোট, বলল পুলিশ

দিলীপ ঘোষের মন্তব্যকেই সমর্থন করেন মৃত বিধায়কের স্ত্রী এবং পরিজনরা। রাতে দেবেন্দ্রনাথ রায়কে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেন তাঁরাও। যে ভাবে দেহ ঝুলছিল বা বাড়ি থেকে যত দূরে দেহটি ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল, তাতে এই ঘটনা কিছুতেই আত্মহত্যার ঘটনা হতে পারে না বলে দেবেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী ও পরিজনরা জোর দিয়ে বলছেন। জেলা পুলিশ অবশ্য সে সব কথায় গুরুত্ব দিচ্ছে না। দেবেন্দ্রনাথ রায়ের পকেট থেকে উদ্ধার হওয়া সুইসাইড নোটে কয়েক জনের নাম পাওয়া গিয়েছে বলে পুলিশ জানায়। তদন্তের স্বার্থে ওই সব নাম এখন প্রকাশ করা হচ্ছে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়।

রিবারের অভিযোগ, খুন করা হয়েছে দেবেন্দ্রনাথ রায়কে। নিজস্ব চিত্র

সিপিএম এবং কংগ্রেসের তরফেও এই মৃত্যু নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা শুরু হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ রায়ের হেমতাবাদ যে লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে, সেই রায়গঞ্জের প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ সেলিম দাবি করেন, এই মৃত্যুর উপযুক্ত তদন্ত হওয়া দরকার। হেমতাবাদ তথা উত্তর দিনাজপুর জেলার মানুষের কাছে এই ‘মৃত্যুরহস্য’ স্পষ্ট হওয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বলেন, ‘‘বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়ের মৃত্যুর ঘটনা যদি হত্যার ঘটনা হয়, তা হলে তা ভয়ঙ্কর।’’

সিপিএম এবং কংগ্রেস অবশ্য দেবেন্দ্রনাথ রায়কে কটাক্ষ করতেও ছাড়েনি। ২০১৬ সালে যে তিনি কংগ্রেস সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন এবং পরে বিজেপিতে যোগ দেন, সে কথা এ দিন মনে করিয়ে দিয়েছেন সেলিম ও সোমেন দু’জনেই। সেলিমের কথায়, ‘‘যে দিন উনি দিল্লিতে গিয়ে বিজেপির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাঁর বিবেকের আত্মহত্যা সে দিনই ঘটেছিল। দেশ ও মানুষের নিরাপত্তার বদলে যাঁরা ব্যক্তি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এ দল ও দল করছেন, দেবেন রায়ের এই অসহায় পরিণতি তাঁদের সৎ মতি ফিরে পেতে সাহায্য করবে।’’ আর সোমেন মিত্র লেখেন, ‘‘উনি বিজেপির বিধায়ক ছিলেন না। বাম-কংগ্রেসের জোটের প্রার্থী হিসেবে উনি জয়লাভ করেন। দিশাহীন স্পিকার ও তৃণমূল-বিজেপির আঁতাতের কারণে ওঁর বিধায়ক পদ বাতিল হয়নি।’’

আরও পড়ুন: বিধায়কের দেহ উদ্ধার ঘিরে উত্তপ্ত রাজ্য, উত্তরবঙ্গ বন্‌ধের ডাক

বিজেপি অবশ্য তীব্র আক্রমণের রাস্তায় হেঁটেই রাজ্য প্রশাসনের উপরে চাপ ক্রমশ বাড়াতে শুরু করেছে। রাজ্যের পুলিশ কিছুতেই নিরপেক্ষ তদন্ত করবে না, এই ‘খুন’কে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালানোর চেষ্টা হবে— বার বার অভিযোগ করতে থাকে বিজেপির গোটা রাজ্য নেতৃত্ব। দেবেন্দ্রনাথ রায়ের রহস্যমৃত্যুর সিবিআই তদন্ত করতে হবে বলে দিলীপ ঘোষ দাবি তোলেন। বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ রাজ্য বিজেপির সদর দফতর থেকে দিলীপের নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল বেরোয়। সঙ্গে ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ, সহ-সভাপতি রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় ও অর্জুন সিংহ, সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু ও সঞ্জয় সিংহ, রাজ্য সম্পাদক সব্যসাচী দত্ত, মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের উপরে সর্দার পটেলের মূর্তির পাদদেশে পৌঁছে মিছিল শেষ হয়। তত ক্ষণে রাজ্য প্রশাসন ঘোষণা করে দিয়েছে যে, দেবেন রায়ের মৃত্যুর তদন্ত করবে সিআইডি। কিন্তু দিলীপরা জানিয়ে দেন সিআইডি তদন্ত বিজেপি মানবে না। এই ঘটনার তদন্ত সিবিআই-কে দিয়ে করানোর জন্য প্রয়োজনে বিজেপি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবে বলে দিলীপ এ দিন জানান।

মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গে ১২ ঘণ্টার বন্‌ধের ডাক দিয়েছে বিজেপি। প্রতিবাদ মিছিল থেকেই দিলীপ ঘোষ বন্‌ধের কথা ঘোষণা করেন। তবে প্রতিবাদ গোটা রাজ্যেই হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। যে ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিবাদে রাজ্যের সর্বত্র বিজেপি কর্মীদের বিক্ষোভে নামতে দিলীপ নির্দেশ দিয়েছেন।

তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য বিজেপির অভিযোগকে এ দিন পাত্তাই দিতে চাননি। দেবেন্দ্রনাথ রায়ের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের ঘটনাকে ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ (নর্ম্যাল) বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। বিজেপি ‘লাশধরার’ রাজনীতি করে বলে কটাক্ষ তাঁর। ওই রাজনীতির কারণেই ‘স্বাভাবিক’ ঘটনাতেও সিবিআই তদন্ত চাওয়া হচ্ছে বলে ফিরহাদের মত। কোনও রহস্যের কিনারা করার প্রশ্নে সিবিআই-এর থেকে পুলিশ অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বলেও মন্তব্য করেছেন ফিরহাদ হাকিম। বিজেপি নেতাদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়!’’ দেবেন্দ্রনাথ রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় এ দিন অবসাদ তত্ত্বও এনেছেন ফিরহাদ হাকিম। বিজেপিতে যাঁরা যান, তাঁরাই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন, এ ক্ষেত্রেও সে রকমই ঘটেছে— কটাক্ষের সুরে এমনই মন্তব্য করেন রাজ্যের পুরমন্ত্রী।

রাজ্য বিজেপি অবশ্য সোমবার সকাল থেকেই নানা ভাবে প্রশাসনের উপরে চাপ বাড়াতে শুরু করেছে। মৃত বিধায়কের পোস্টমর্টেমের সময়ে হাসপাতালে হাজির হয়ে যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রায়গঞ্জের সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরী। পুরো প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ঘটনাস্থল ছেড়ে নড়েননি বলে বিজেপি সূত্রে জানানো হয়েছে। তবে পোস্টমর্টেমে কী পাওয়া গেল বা গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আদৌ কিছু জানতে দেওয়া হল কি না, সে বিষয়ে বিজেপির তরফ থেকে কিছু জানা যায়নি। অন্য দিকে, বিধায়কের রহস্যমৃত্যুর খবর পেয়েই ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা বিজেপি নেতাদের দ্রুত সেখানে পৌঁছনোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদার, মালদহ উত্তরের সাংসদ খগেন মুর্মু এবং মালদহের আর এক নেতা তথা রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি বিশ্বপ্রিয় রায়চৌধুরীও দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যান হেমতাবাদে। রাজ্যে জুড়ে বিক্ষোভের প্রস্তুতি শুরু করে যুব মোর্চাও।

কলকাতায় এ দিনের প্রতিবাদ মিছিল শেষে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের দ্বারস্থও হয়েছে বিজেপি। দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল রাজভবনে গিয়ে এ দিন স্মারকলিপি দিয়েছে এসেছে রাজ্যপালকে। ধনখড় অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই সক্রিয় হয়েছেন বিষয়টি নিয়ে। রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিহিংসা বন্ধ হওয়ার কোনও ইঙ্গিতই নেই— টুইটারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ট্যাগ করে এ কথা লেখেন ধনখড়। বিধায়কের দেহ মেলার সঙ্গে সঙ্গেই যে ভাবে পুলিশ আত্মহত্যার কথা বলতে শুরু করেছে, তাতে সত্য গোপন করার ইঙ্গিত মিলছে বলেও রাজ্যপাল এ দিন টুইটারে লেখেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement