রোগীর সংখ্যা দিনে কয়েক হাজার। অথচ, কোনও গোলমাল হলে হাসপাতালের আউটপোস্টে পুলিশ হাতেগোনা!
এই পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালগুলিতে ভাঙচুর এবং চিকিৎসক-নিগ্রহ ঠেকাতে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। তাতে বলা হয়েছিল, রাজ্য জুড়ে সরকারি হাসপাতালগুলির জন্য ৩,২০০ সিভিক পুলিশ নিয়োগ করা হবে। সেই প্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য ছিল, হাসপাতালে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হলে বা রোগী-মৃত্যু ঘটলে মারমুখী পরিজন ও জনতার সামনে খালি হাতে সেই সিভিক পুলিশকর্মীরা নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। কিন্তু অভিযোগ, সরকার সে কথা গ্রাহ্য করেনি।
চিকিৎসক মহলের একাংশের দাবি, ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল তাঁদের ছ’টি সংগঠনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। তাতে হাজির ছিলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব, কলকাতা পুলিশের ডিজি, পুলিশ কমিশনার-সহ শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্তা। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সংগঠনগুলির তোলা একগুচ্ছ দাবি যাতে মানা হয় তা নিশ্চিত করতে। ডাক্তারদের একটি সূত্র বলছে, ওই দাবিগুলি কার্যকর হলে হয়তো গত ১০ জুন এন আর এসে গোলমালের ঘটনা এড়ানো যেত। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সভাপতি, চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘আমরা একগুচ্ছ দাবি জানিয়ে এসেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী সব শুনে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে সেই দাবিগুলি মেনে চলা হয়। কিন্তু বছর ঘুরে গেলেও কিছু মানা হয়নি।’’ ধীরে ধীরে ওই সব দাবি কার্যকর করা হলে এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মতো ঘটনা ঘটত না বলেই মনে করছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ১০ জুন সোমবার বিকেলে এন আর এসে মৃত্যু হয় ট্যাংরার বাসিন্দা, পঁচাত্তর বছরের মহম্মদ শাহিদের। সেই ঘটনাকে ঘিরে রোগীর পরিবার ও লোকজনের সঙ্গে গোলমাল শুরু হয় জুনিয়র ডাক্তারদের। অভিযোগ, দু’পক্ষই একে অপরের উপরে চড়াও হয়। রোগীর পরিজনেদের ছোড়া পাথরে মাথায় আঘাত পান এক জুনিয়র ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায়। তাঁর করোটির হাড় ভেঙে মাথায় ঢুকে যায়।
স্বাস্থ্য দফতরের জারি করা সেই বিজ্ঞপ্তি। নিজস্ব চিত্র
এর পরেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে রাজ্য জুড়ে আন্দোলন শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। শহরের সব সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি জেলার সরকারি হাসপাতালগুলিতেও শুরু হয় কর্মবিরতি। রবিবার যে আন্দোলন ষষ্ঠ দিনে পড়ল। এ দিনও দূর-দূরান্ত থেকে এসে ফিরে গিয়েছেন একাধিক রোগী। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারেরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন থেকে সরবেন না। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে কি একেবারেই নিরাপত্তা নেই?
রোগীর অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা যে নগণ্য, তা দেখা গিয়েছে শহরের একাধিক হাসপাতাল ঘুরে। এসএসকেএমের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে আসেন ছ’-সাত হাজার রোগী। ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কম করে হলেও তিনশো। পাশাপাশি, জরুরি বিভাগে প্রায় প্রতি মুহূর্তে সঙ্কটজনক রোগীর ভিড় থাকে। অথচ ওই হাসপাতালের আউটপোস্টে পুলিশকর্মী রয়েছেন সাকুল্যে আড়াইশো জন! যাঁর মধ্যে এক জন আইসি ছাড়া রয়েছেন সাব-ইনস্পেক্টর, অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর, কনস্টেবল, হোমগার্ড-সহ স্বাস্থ্য দফতর থেকে নিয়োগ করা সিভিক পুলিশ। একই ভাবে আর জি করে পুলিশের সংখ্যা দেড়শো জনের মতো। এম আর বাঙুর হাসপাতালে আবার সেই সংখ্যা মাত্র ৫০। ন্যাশনাল মেডিক্যাল এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছেন ১০০ জনের মতো পুলিশকর্মী। ডাক্তারদের একাংশ বলছেন, হাতেগোনা এই পুলিশ থাকায় কোনও গোলমালের আঁচ পেলে তাঁদের হস্টেল বা অন্য ওয়ার্ড থেকে জুনিয়রদের ডেকে পাঠাতে হয় আত্মরক্ষার স্বার্থে।
যদিও পুলিশের এক কর্তা দাবি করেছেন, পরিস্থিতি আঁচ করে হাসপাতালের আউটপোস্ট বা স্থানীয় থানার তরফে জানানো হলে লালবাজার থেকে বাড়তি বাহিনী পাঠানো হয়। তা ছাড়া কলকাতার সরকারি হাসপাতালের বাইরে এবং কাছাকাছি দূরত্বে হাই রেডিয়ো ফ্লাইং স্কোয়াডের ভ্যান থাকে। প্রয়োজন পড়লে তাদের ডাকার পাশাপাশি লালবাজারের কন্ট্রোল রুমেও খবর দেওয়া হয়। এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘স্থানীয় থানার ওসি অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর এলাকার হাসপাতালগুলির সঙ্গে এমন সম্পর্ক তৈরি করে রাখেন যে সামান্যতম গোলমালের আঁচ পেলেই আগে থেকে ফোর্স চেয়ে পাঠান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।’’