ভোটের ভাবনায় কল্পতরু

প্রোমোটার, ভাড়াটে, মালিককে বিপুল ছাড়

কলকাতা-সহ রাজ্যের সমস্ত পুর এলাকায় পুরনো বাড়ি ভেঙে গড়া এবং নতুন বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাপক ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সরকার। মঙ্গলবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত নতুন নগরোন্নয়ন নীতিতে বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি পুরনো বাড়ির ভাড়াটেরা মালিকের প্রস্তাবে সম্মত হলে সেই সব বাড়ি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বাড়তি এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) মিলবে। বিপজ্জনক বাড়ি নতুন করে নির্মাণ করা হলেও ওই একই সুযোগ পাওয়া যাবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৪ ০৩:২৫
Share:

কলকাতা-সহ রাজ্যের সমস্ত পুর এলাকায় পুরনো বাড়ি ভেঙে গড়া এবং নতুন বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাপক ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সরকার। মঙ্গলবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত নতুন নগরোন্নয়ন নীতিতে বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি পুরনো বাড়ির ভাড়াটেরা মালিকের প্রস্তাবে সম্মত হলে সেই সব বাড়ি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বাড়তি এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) মিলবে। বিপজ্জনক বাড়ি নতুন করে নির্মাণ করা হলেও ওই একই সুযোগ পাওয়া যাবে।

Advertisement

এখানেই শেষ নয়। বৃহৎ আবাসন প্রকল্প, হাসপাতাল, তথ্য-প্রযুক্তি ভবন এবং মেগা বাণিজ্যিক প্রকল্পের জন্য ১৫% অতিরিক্ত এফএআর পাওয়া যাবে। মেট্রো রেলের যাত্রাপথের দু’পাশে ৫০০ মিটারের মধ্যে বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রেও বিরাট ছাড় দেওয়া হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে ছাড় পেতে হলে প্রস্তাবিত নতুন বা পুরনো আবাসন প্রকল্পগুলি ১৫-২৪ মিটার চওড়া রাস্তার ধারে হতে হবে। যদি ১৫ মিটার চওড়া রাস্তার পাশে আবাসন হয়, তা হলে অতিরিক্ত ১৫% এফএআর মিলবে। রাস্তা ২৪ মিটার বা তার বেশি চওড়া হলে ছাড়ের পরিমাণ হবে ২০%।

বাড়ি তৈরির আইনকানুন শিথিল করার জন্য নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের দাবি দীর্ঘদিনের। তা ছাড়া, ভাড়াটে-বাড়িওয়ালা বিবাদে বহু বাড়ি ক্রমেই জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে। ভাড়াটে তোলা যাচ্ছে না বা নতুন বাড়িতে তাদের যথেষ্ট জায়গা দেওয়া যাবে না এই কারণে থমকে রয়েছে পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তোলার ভাবনা। সেই সমস্যা মেটাতে আর নির্মাণ শিল্পকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থাই নতুন নগরোন্নয়ন নীতিতে করা হল বলে সরকারি সূত্রের দাবি।

Advertisement

কিন্তু এই নীতি বেশ কিছু বড় মাপের প্রশ্নও তুলে দিয়েছে। পুর পরিষেবা ও পরিকাঠামোর ব্যবস্থা না করে সংকীর্ণ রাস্তায় বহুতল তোলার অনুমতি দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা। অন্য দিকে বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের মদতে যে প্রোমোটিং এবং সিন্ডিকেট-রাজ রাজ্য জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের পথ আরও প্রশস্ত করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি রয়েছে আগামী বছর কলকাতা, আসানসোল, শিলিগুড়ি-সহ ৮৭টি পুরসভার নির্বাচনের আগে বাড়িওয়ালা থেকে ভাড়াটে সবাইকে খুশি করে ভোট কেনার চেষ্টা।

লোকসভা ভোটে বিজেপির উত্থান, খাস মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে দেওয়া পুরভোটের এক বছর আগে শাসক দলকে যে চিন্তায় রেখেছে, তাতে সন্দেহ নেই। আসানসোল এবং শিলিগুড়ি পুর এলাকাতেও বিজেপির অগ্রগতি চাপে রেখেছে তৃণমূলকে। এই অবস্থায় নানা ভাবে শহুরে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টার কসুর করছে না মমতার দল।

ভোটারদের খুশি করতে সরকার যে ইতিমধ্যেই কলকাতায় বাড়ির রঙ নীল-সাদা করলে কর ছাড় দেওয়া থেকে শুরু করে ভাড়াটের সম্মতি ছাড়া পুরনো বাড়ির সংস্কার করতে না-পারার মতো বিবিধ পুর-সিদ্ধান্ত জারি করেছে, সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিরোধীরা। আদালতের নির্দেশে জরিমানা দিয়ে কোনও বাড়ির বেআইনি অংশকে আইনসিদ্ধ করার প্রথা খারিজ হওয়ার পরে তা ঠেকাতে আইন সংশোধনের কথাও ভাবছে রাজ্য সরকার।

এ বারের সিদ্ধান্তে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে-প্রোমোটার-সিন্ডিকেট সব পক্ষকে এক সঙ্গে খুশি করার ব্যবস্থা করে দিল সরকার। বিরোধীদের মতে, ভাড়াটে-সহ পুরনো বাড়ি ভেঙে গড়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ছাড় যেমন বাড়িওয়ালাদের তুষ্ট করবে, তেমনই তাদের ‘অধিকার’ অক্ষুণ্ণ থাকার জন্য বিপুল সংখ্যক ভাড়াটিয়াও সরকারকে সাধুবাদ দেবেন। একই ভাবে প্রোমোটার, সাপ্লায়ার, ঠিকাদার থেকে শুরু করে সিন্ডিকেট-দাদাদেরও বিপুল সমর্থন থাকবে সরকারের পাশে। সরকারের উজাড় করা ছাড়ের সুযোগে শহর জড়ে প্রোমোটারি কারবার যেমন ছড়াবে, তেমনই পকেট ভরবে সাপ্লায়ার, ঠিকাদার, সিন্ডিকেটের দাদাদেরও।

রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের আশঙ্কা, “যদি এ ভাবে ছাড় দেওয়া হয়, তা হলে দুর্নীতি প্রশ্রয় পাবে। বড় প্রোমোটার, ডেভেলপারদের বেআইনি কাজে আরও বেশি উৎসাহিত করা হবে। সেই সঙ্গে বেআইনি ভাবে প্রচুর টাকার লেনদেন হবে।” অশোকবাবু আরও বলেন, “বিপজ্জনক বাড়ির ক্ষেত্রে সব সময়েই সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু যে ভাবে ১০০% অতিরিক্ত ফ্লোর এরিয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছে, তাতে দুর্নীতি বাড়বে।” বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা বহির্ভূত জমি রাখার যে কথা বলা হচ্ছে, সে প্রসঙ্গে অশোকবাবু বলেন, “আমরা যখন শিল্পের স্বার্থে জমির কথা বলেছিলাম, তখন ওরা বাধা দিয়েছে। শিল্প করতে দেয়নি। কিন্তু এখন বড় প্রোমোটারদের স্বার্থে ওরা এ কাজ করছে!”

বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অভিযোগ, রাজারহাটে বাম আমলে নামমাত্র দামে কৃষকদের জমি আদায় করে নেওয়া হয়েছিল। এ বার তৃণমূলও একই কায়দায় শহরে ‘বাড়ি দখল’ করবে। ভাড়াটের সম্মতি আদায় করা হবে মস্তান বাহিনীকে দিয়ে! রাহুলবাবুর কথায়, “পুরভোটের দিকে তাকিয়েই এমন সিদ্ধান্ত। এর পরে তো সিন্ডিকেট আর তোলাবাজির রমরমা বাড়বে। শহরের বাড়িতে বাড়িতে মস্তান বাহিনীর দাপট চলবে!”

আপাতদৃষ্টিতে এমন নগর-নীতি ভাল বলে মন্তব্য করেও সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া। তাঁর বক্তব্য, “এই নীতি শুনতে ভাল। তবে নীতি কার্যকর করার সময় দেখতে হবে, রাজারহাট-দমদমের সিন্ডিকেট যেন কলকাতায় উঠে না আসে। এই নীতির ফলে স্বাভাবিক ভাবে নির্মাণ শিল্প উৎসাহ পাবে, ‘বুম’ আসবে। তখন সিন্ডিকেট আর দুষ্কৃতী দাপট যাতে না বাড়ে, তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।”

বিরোধীরা সমালোচনা করলেও নির্মাণ সংস্থাদের সংগঠন ক্রেডাই সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে সংগঠনের পক্ষে সুশীল মোহতা ও প্রদীপ সুরেকা জানান, পরিকাঠামোর সঠিক ব্যবস্থা না করে এফএআর বাড়ালে ফল নেতিবাচক হতে পারে। যে হারে বাড়ির জায়গা বাড়বে, সেই অনুপাতেই পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে। নচেৎ শহরের নাগরিক পরিষেবা ব্যাহত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে রাজ্যে জমির বড় অভাব, সেই রাজ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত। সিঙ্গাপুর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এফএআর ১২ থেকে ২১ গুণ। এখানে তা ৩ থেকে ৪ গুণ। জমির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহারের জন্য এফএআর-এর ঊর্দ্ধসীমা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজ্যের নতুন আবাসন নীতি তৈরির জন্য বছরখানেক আগে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে মাথায় রেখে একটি মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় ৩০টি বৈঠকে নানা পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে সেই মন্ত্রিগোষ্ঠী। নীতি ঘোষণার পরে অর্থমন্ত্রীর দাবি, নতুন নীতিতে এক দিকে যেমন আবাসন শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগের দরজা খুলে গেল, তেমনই রাজস্ব আদায়ের সুযোগও থাকল। বাড়তি রাজস্ব অবশ্য সরাসরি কোষগারে জমা হবে। তার পরে প্রয়োজনে পুর পরিষেবার কাজে তার ব্যবহার হবে। আর পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “প্রয়োজনীয় আইন-কানুন বদলের পর পুরসভাগুলিতে ৬ মাস থেকে এক বছর সময় দেওয়া হবে। তার পরই নতুন নিয়ম কার্যকর হবে।”

পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন করে গড়া ছাড়াও পরিবেশ বান্ধব ‘গ্রিন বিল্ডিং’ নির্মাণের জন্যও এফএআরে বাড়তি ১০% ছাড় দেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তা ছাড়া, পুর এলাকায় বসতবাড়ির ৪৫% এলাকা বাণিজ্যিক কাজে লাগানো যাবে। সে জন্য ক্ষতিকারক নয় এমন ৫০টি সামগ্রী চিহ্নিত করে দিয়েছে সরকার। পুর কর্তৃপক্ষকে ফি দিয়ে বাড়িতেই এখন ওই ধরনের সামগ্রীর ব্যবসা চালানোর সুযোগ মিলবে। পুরনো এবং মামলাযুক্ত বাড়ি কেনা-বেচার ক্ষেত্রেও অবমূল্যায়িত হারে (ডেপ্রিসিয়েশন) স্ট্যাম্প ডিউটি ও রেজিস্ট্রেশন ফি ধার্য হবে। উপনগরী, ট্রান্সপোর্ট হাব, লজিস্টিক হাব, টার্মিনাল তৈরির ক্ষেত্রেও সিলিং অতিরিক্ত জমি রাখার অনুমতি দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যে আবাসন শিল্পে জোয়ার আসবে বলে দাবি করেছেন অমিতবাবু ও ফিরহাদ হাকিম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement