বিতর্কিত সেই পোস্ট
অনেকের চোখেই বিজেপি ‘মনুবাদী’ দল। শনিবার সেই দলেরই মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র একটি ফেসবুক পোস্টে সেই অভিযোগ তীব্র হয়ে উঠল। পরিস্থিতি বুঝে পরে অবশ্য বাবুল ফেসবুকে একটি ব্যাখ্যা দেন।
ঘটনার সূত্রপাত তৃণমূলের নতুন স্লোগান— ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’-এর প্রতি বাবুলের কটাক্ষমূলক পোস্ট থেকে। বাবুলের ফেসবুক পেজে এ দিন দু’টি পোস্টার পোস্ট করা হয়। প্রথমটিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে মাইক্রোফোন এবং পাশে হিন্দিতে লেখা, ‘‘ম্যায় বঙ্গাল কি বেটি হুঁ (আমি বাংলার মেয়ে)।’’ দ্বিতীয় পোস্টারে অমিত শাহের করজোড় ছবি এবং পাশে হিন্দিতে লেখা, ‘‘বেটি পরায়া ধন হোতি হ্যায়, ইস বার বিদা কর দেঙ্গে ( মেয়ে পরের সম্পত্তি, এ বার বিদায় করে দেব)।’’ ওই দু’টি ছবির উপরে লেখা হয়, ‘কর হি দেঙ্গে ইস বার বিদা হ্যাশট্যাগ পরিবর্তন ইন বেঙ্গল’। সবার উপরে লেখা হয় ‘পোস্টেড বাই: বিজেপি আসানসোল অফিশিয়াল’।
বাবুল ফেসবুকে ওই পোস্ট দেওয়ার পরই তা ভাইরাল হয়ে যায়। সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে বাবুল এবং তাঁর দল বিজেপির প্রতি শ্লেষাত্মক মন্তব্য। শুধু বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীরা নন, সাধারণ মানুষও বাবুল এবং তাঁর দল বিজেপিকে ‘নারীবিদ্বেষী’, ‘মনুবাদী’, ‘সামন্ততান্ত্রিক’ ইত্যাদি নানা চোখা চোখা বিশেষণে বিশেষিত করেন। বিজেপির বিরোধী তিন রাজনৈতিক দল তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেসও একই সুরে ওই মন্তব্যের নিন্দা করে। বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ও বাবুলের মন্তব্যের বিরোধিতা করেন।
তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী তথা রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পুরুষতান্ত্রিক রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে এগিয়ে চলা মেয়েরা যখন আগামী ৮ মার্চ আবার একটা নারী দিবস পালন করবেন, তখন বাবুল সুপ্রিয়র ওই পোস্ট ফের বুঝিয়ে দিল বিজেপি একটা সামন্ততান্ত্রিক দল, মেয়েদেরকে ওরা সম্পত্তি বলে মনে করে। বাংলার ভোটে লড়তে এসে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিজেপি নেতারা আধুনিক মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। কিন্তু মাঝেমধ্যেই মেক আপ উঠে গিয়ে ভিতরের আসল চেহারা বেরিয়ে আসছে।’’ চন্দ্রিমার সংযোজন, ‘‘বিজেপি নেতারা যাঁদের পরায়া ধন বলছেন, তাঁদের পিতৃগৃহ এবং শ্বশ্রুগৃহকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের মধ্য দিয়ে মিলিয়ে দিয়েছেন। এটা শিখতে ওঁদের অনেক সময় লাগবে।’’
রাজ্যের আর এক মন্ত্রী শশী পাঁজাও টুইট করেন, ‘‘আপনার মতো জনপ্রতিনিধি এই রকম প্রভুত্ববাদী চিন্তাকে সমর্থন করছেন! দেশে মহিলাদের অবস্থা নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ছি। বিজেপি নেতারা যে কত গভীর ভাবে লিঙ্গবৈষম্যে বিশ্বাস করেন, তা দেখে স্তম্ভিত!’’
সিপিএমের গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদক কনীনিকা ঘোষ বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের দৈন্য হল, শেষ বেলায় এসে তাঁকে নিজেকে বাংলার মেয়ে হিসাবে তুলে ধরতে হচ্ছে। কিন্তু আসলে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের পদ। আমরা যখন মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতা করি, তখন কোনও ছেলে বা মেয়ে হিসাবে তাঁকে দেখি না, ওই পদের নীতির বিরোধিতা করি। আর অমিত শাহরা তো মনুবাদীই। তাঁরা মেয়েদের ঠাকুরঘর, আঁতুড়ঘর এবং রান্নাঘরের বাইরে কোথাও ভাবতেই পারেন না। সুতরাং, তাঁদের কাছ থেকে এমন পোস্ট ছাড়া আর কীই বা প্রত্যাশিত?’’ কনীনিকার সংযোজন, ‘‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও বিজেপির জুমলাবাজি। ওরা বরং স্বীকার করুক, ওদের আসল মতাদর্শ মনুবাদ।’’
আর প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণা দেবনাথের বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে। কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং এক জন মহিলার প্রতি বিজেপির এই অপমানজনক মন্তব্যকে ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই। আসলে বিজেপি নেতারা বাংলার সংস্কৃতি বোঝেন না। এই অঞ্চলে যে নবজাগরণ হয়েছিল, তার দর্শনও বোঝেন না। ওঁরা নবজাগরণের আগেকার সতীদাহের যুগে পড়ে আছেন। মেয়েদের ভোগ্য ভাবার যোগ্য জবাব বিধানসভা ভোটে বিজেপি পাবে।’’
বিজেপি সাংসদ তথা দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক লকেটও বাবুলের ওই মন্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, ‘‘আমিও শ্বশুরবাড়ি গেছি। এটা বাংলার সংস্কৃতি নয়। বাংলায় মেয়েরা বিয়ে হলেও মা-বাবার নিজের মেয়েই থাকে, আর শ্বশুরবাড়িতেও বউ থেকে মেয়েই হয়ে ওঠে। মা দুর্গাদের অপমান করা উচিত নয়।’’
বাবুল ওই পোস্ট করার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে দাবি করা হয়, তিনি একটি মজার পোস্ট করেছেন। এতে অন্য কিছু খোঁজা অর্থহীন। যদিও পরে বাবুল বলেন, ‘‘এটুকুই বলব যে, এটি একটি বহুল প্রচারিত মিম। বেশ কয়েক দিন ধরে এটি সোশ্যাল মিডিয়াতে রয়েছে। এই মিম-টি আমার বানানো নয় বা আমার দেওয়া কোনও বিবৃতিও নয়। আমার দুটি মেয়ে আছে। কাজেই অন্য কোনও ‘রাজনৈতিক’ দলের কাছ থেকে (তৃণমূলই হোক বা বাম-কংগ্রেস হোক) নারীবিদ্বেষের সংজ্ঞা শিখতে হবে না।’’