পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ এবং জবরদখলদারীদের উচ্ছেদের ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার আর্জি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিচ্ছে কেন্দ্র। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী জানান, পশ্চিমবঙ্গে সড়ক পরিকাঠামো নির্মাণে অর্থের কোনও অভাব হবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজ্যকেও নিজের ভূমিকা পালন করতে হবে। এ কথা জানিয়ে মমতাকে চিঠি লিখছেন তিনি নিজেই।
পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সড়ক নির্মাণের বিভিন্ন প্রকল্প সাত থেকে দশ বছর ধরে আটকে রয়েছে। গডকড়ীর মতে, এ ব্যাপারে মূল সমস্যা দু’টি। জমি অধিগ্রহণ এবং রাস্তার পাশে জবরদখলদারীদের উচ্ছেদ করা। তাঁর কথায়, “আমি চাই মুখ্যমন্ত্রী নিজে গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করুন। বিশেষ করে জবরদখলদারীদের উচ্ছেদ করাটা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে। রাজ্য সহযোগিতা করলে কেন্দ্র দু’হাত বাড়িয়ে পরিকাঠামো নির্মাণ করবে। এর জন্য টাকার চিন্তা রাজ্যকে করতে হবে না।”
মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত কাল ও আজ দিল্লিতে রাজ্যওয়াড়ি পূর্ত দফতরের সচিবদের বৈঠকে ডেকেছিলেন গডকড়ী। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ত দফতরের কর্তাদের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করেন। আজ তিনি জানান, ইস্ট-ওয়েস্ট করিডর, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক, বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণ-সহ প্রতিটি প্রকল্প ধরে ধরে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, প্রতি ক্ষেত্রেই সমস্যার শিকড় রয়েছে রাজ্যে। আর সেই জন্যই মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।
এ দিন রাজ্যের তরফে বৈঠকে হাজির ছিলেন জাতীয় সড়ক উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়াররা। তাঁরা মন্ত্রীকে জানান, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণে বেশ কিছু জায়গায় জমির সমস্যাই অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় এখন প্রকল্পের খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। ফলে ঠিকাদার সংস্থাগুলি আর ব্যাঙ্ক ঋণ পাচ্ছে না। জমি এবং টাকার সমস্যার কারণেই বারাসত থেকে ডালখোলা পর্যন্ত ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ এখনও তেমন গতি পায়নি বলে জানান তাঁরা। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা যে সম্ভব নয়, সে কথাও মন্ত্রীকে জানিয়ে দেন রাজ্যের অফিসাররা। জবরদখলের সমস্যা রয়েছে বারাসত থেকে বনগাঁ-পেট্রাপোল সীমান্ত পর্যন্ত ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়কেও।
এ ছাড়া শিলিগুড়ি থেকে ফালাকাটা হয়ে সলসলাবাড়ি পর্যন্ত ১৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১ডি নম্বর জাতীয় সড়কের চার লেনে সম্প্রসারণের কাজও এখনও শুরু হয়নি। রাজ্যের অফিসাররা মন্ত্রীকে জানান, দু’বার দরপত্র ডাকা সত্ত্বেও ৩১৫০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ করতে এগিয়ে আসেনি কোনও সংস্থা। তাই প্রকল্পটি ভেঙে ভেঙে ফের দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে স্থির হয়েছে। দফতরের একাংশ অবশ্য জানাচ্ছে, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে কাজ করার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার পর কোনও বড় সংস্থাই এ রাজ্যে কাজ করতে আসতে চাইছে না। কারণ, জমি অধিগ্রহণ বা জবরদখল উচ্ছেদের কাজে রাজ্য সরকার এতটাই উদাসীন যে, সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা দুষ্কর। সেই কারণেই ‘বিল্ড-অপারেট-ট্রান্সফার’ (বিওটি) পদ্ধতিতে কোনও বড় সংস্থা এখানে কাজ করতে আসতে চাইছে না।
এ দিনের বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের এক কর্তা আজ জানান, সড়ক পরিকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে পূর্বতন সরকারও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোনও বঞ্চনা করেনি। কারণ, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহই ‘পুবে তাকাও নীতি’ ঘোষণা করেছিলেন। তার পর ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরের কাজ দ্রুত শেষ করায় জোর দেয় কেন্দ্র। মন্ত্রকের ওই কর্তার কথায়, পশ্চিমবঙ্গের এই সব জাতীয় সড়ক প্রকল্পের রূপায়ণ ও সম্প্রসারণের সঙ্গে জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থও জড়িত। কলকাতা বন্দর থেকে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে পণ্য পরিবহণ, বাংলাদেশ-মায়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি সবই এই প্রকল্পগুলির উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু রাজ্য সক্রিয় না হওয়ায় রূপায়ণে অনেক বেশি সময় লাগছে বলে তাঁর মত। প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে যখন জাতীয় সড়ক সম্প্রসারিত হয়ে দু’লেন থেকে চার বা ছ’লেনের হয়ে যাচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গে কাজ এগোচ্ছে না।
এ ব্যাপারে আজ মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করেন প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাঁর কথায়, “৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের যেটুকু অংশ মুর্শিদাবাদের মধ্যে রয়েছে, সেখানে কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনায় কাজ কার্যত এগোচ্ছে না। এর জন্য মুখ্যমন্ত্রীই দায়ী। তিনি সস্তার রাজনীতি করতে গিয়ে রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়নকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছেন।” অধীরের অভিযোগ, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের কাজ শেষ না হওয়ায় উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। কলকাতা বন্দরের সঙ্গে ঘুরপথে পানাগড় হয়ে যোগাযোগ রাখতে গিয়ে পরিবহণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জমি অধিগ্রহণ ও জবরদখল সমস্যার জন্য রাজ্যের রেল প্রকল্পের রূপায়ণও অনেক জায়গায় থমকে রয়েছে বলে জানিয়ে অধীর বলেন, “রাজ্যে এক অপদার্থ সরকারের পর আর এক অপদার্থ সরকার এসেছে। যারা শুধু রাজনীতিটাই করছে, তার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করছে না।”
গডকড়ীর চিঠিতেও রাজ্য নড়ে বসবে কি?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অধিকাংশ কিন্তু এ ব্যাপারে সংশয়ী। তৃণমূল নেত্রীর ঘোষিত অবস্থান, এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণ করবে না তাঁর সরকার। সেই জটেই আটকে পড়েছে সড়ক, রেল, বিদ্যুতের একের পর এক প্রকল্প। কাজেই নিতিনের চিঠি সেই জট সহজে ছাড়াতে পারবে কি না, সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন!
তবে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেই নরেন্দ্র মোদী মমতাকে বার্তা দিয়েছেন, রাজনীতির সঙ্গে প্রশাসনকে মেশাতে চান না তিনি। টাকার অভাব হবে না বলে এ বার সেই বার্তা দিলেন গডকড়ীও।