Transgender

গর্বের দিনে ‘ছেলে’কে ফিরে আসার ডাক মায়ের

শহরে ছড়িয়ে থাকা রূপান্তরকামী ছেলেমেয়েদের মধ্যেই আজও হন্যে হয়ে সেই সন্তানকে খুঁজে চলেছেন মা।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৩:০৮
Share:

খোঁজ: ছেলে তনুুর ছবি নিয়ে অপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

বাবার উপরে অভিমান করে ‘ছেলে’ বলেছিল, আঠেরো বছর পূর্ণ হলেই বাড়ি ছেড়ে ছুট দেবে সে। কিন্তু তা যে সত্যি হবে, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি মা।

Advertisement

সেই ঘটনার পরে কেটে গিয়েছে দশ বছর। তবু আজও হদিশ মেলেনি সেই অভিমানী সন্তানের। কিন্তু এ শহরে ছড়িয়ে থাকা রূপান্তরকামী ছেলেমেয়েদের মধ্যেই আজও হন্যে হয়ে সেই সন্তানকে খুঁজে চলেছেন মা।

রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বরের ঐতিহাসিক দিনে তাঁর ‘বড় ছেলে’ উৎসব ওরফে তনুর কথাই বলছিলেন অপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়। যাঁর উপস্থিতি অনুভব করতে বাড়ির কাছে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে রূপান্তরকামীদের ‘আস্তানা’য় যাবেন বলেই স্থির করে রেখেছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য জরুরি পারিবারিক দরকারে বেহালায় মায়ের বাড়ি যেতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তবু সারা ক্ষণ ছুঁয়ে আছে ‘হারিয়ে যাওয়া’ সন্তানের স্পর্শ।

Advertisement

দু’বছর আগের এই দিনটাতেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অন্যায় আইন থেকে মুক্ত হয়েছিলেন রূপান্তরকামী-সমকামীরা। যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকারের লড়াইয়ে এই দিনটা তাই দিকচিহ্ন। তবে ১০ বছর আগে দেশের ছবিটা কিন্তু এমন ছিল না। অপর্ণার আফশোস, ‘‘তনু যে একটু আলাদা, তা তখন বুঝিনি। কাকে যে রূপান্তরকামী বলে, তা-ও বুঝতাম না। এখন ওর মতো আরও ক’জনের মধ্যেই ওকে খুঁজে পাই।’’

২০১০ সালের এই দিনে ১৮ ছুঁইছুঁই বয়সের তনু বাড়িতে বলে গিয়েছিল যে, কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। আর ফেরেনি। সুপ্রিম কোর্টে এই অন্যায় আইন হটানোর লড়াই তত দিনে শুরু হয়ে গিয়েছে। ৩৭৭ ধারার অমানবিকতা বন্ধ করতে হলফনামায় সই করেছিলেন ১৯ জন সমকামী সন্তানের মা-বাবা। তবে অপর্ণা অবশ্য তখন এ সবের কিছুই বুঝতেন না।

ছেলের খোঁজে লালবাজারে বহু দৌড়ঝাঁপ করেও তাকে ফিরে পাননি। কিন্তু চোখ খুলেছে ক্রমশ। আস্তে আস্তে ছেলেকে ‘চিনতে’ শিখেছেন। অপর্ণার দাদা-বৌদি দু’জনেই তখন লালবাজারে পুলিশ আধিকারিক। সেই বৌদির সূত্রেই আলাপ হয় রূপান্তরকামী সমাজকর্মী রঞ্জিতা সিংহের সঙ্গে। আর তার পরে রঞ্জিতার সঙ্গে থাকা বহু রূপান্তরকামী ছেলেমেয়েদের মধ্যেই তাঁর তনুকে খুঁজে পান অপর্ণা। তিনি এখন জানেন, ২০১৮ সালের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট বলছে, দেশে ৯৮ শতাংশ রূপান্তরকামী এবং সমকামী সন্তানই তাঁদের পরিবারের থেকে ছিটকে যান। ‘‘আমরা ওকে বুঝতে পারলে তনুকে হয়তো আমাদের কাছেই রাখতে পারতাম।’’— বলে ওঠেন অপর্ণা।

শহরে সদ্য গড়ে ওঠা রূপান্তরকামীদের আশ্রয় হোমটিতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিয়েছেন অপর্ণা। সুযোগ পেলেই সেখানে পৌঁছে যান তিনি। সময় কাটান ছেলেমেয়েগুলির সঙ্গে। সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের দিনে সেখানেও বিজয় অনুষ্ঠান হয়েছে। কলকাতা ছাড়িয়ে জেলাতেও দুঃস্থ রূপান্তরকামীদের জন্য ডানা মেলছে ‘রেনবো কিচেন’। এখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলিও রূপান্তরকামী, সমকামীদের গুরুত্ব বুঝছে। দেশে রূপান্তরকামীদের অধিকারে আইন থেকে ট্রান্স কাউন্সিল গঠিত। রূপান্তরকামী, সমকামীদের মর্যাদা নিয়ে পুলিশকে সচেতন করার কর্মশালা করতে উদ্যোগী বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটও।

বছর সাতচল্লিশের অপর্ণার স্বামী প্রয়াত হয়েছেন কিছু দিন হল। অপর্ণা বলছিলেন, ‘‘ওর বাবা শেষের দিকে ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তনু সাজতে ভালবাসত, ছেলেদের স্কুলে যেতে ওর কষ্ট হত, বিউটিশিয়ান কোর্স করতে চাইত। তখন আমরা ওর কষ্টটা ভাল বুঝতে পারিনি।’’

রূপান্তরকামী নারী তথা সমাজকর্মী রঞ্জিতা বলছেন, ‘‘সমকামী, রূপান্তরকামী আন্দোলনের গর্বের দিনে আরও কত জন হারানো ছেলের কথা মনে পড়ে। আমায় মা বলে ডাকত যে কুন্দন, সে আত্মহত্যা করে। আরও এক জন হিজড়ের খোলে হারিয়ে গেল।’’ অপর্ণা দৃঢ় স্বরে বলেন, ‘‘আগে বলতে পারিনি। আজ আমার সন্তান তনুকে বলছি, ফিরে আয়। তোর সাজপোশাক, ছেলে বা মেয়ে পরিচয় নিয়ে ভাবছি না। কথা দিচ্ছি, এ বার তোর সত্যিকারের মা হয়ে উঠব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement