আসিফের নতুন বোমা, নিশানায় ‘ডাকাতরানি’

কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নয়, মুখ্যমন্ত্রীকে একেবারে ‘ডাকাতরানি’ বলে তোপ দেগে বসলেন আসিফ খান। এর আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারদা কেলেঙ্কারিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। মমতা ‘মিথ্যাবাদী’ বলে অভিযোগ করেছিলেন। সারদার টাকা তৃণমূলে কারা নিয়েছেন প্রশ্ন করায় এর আগে তাঁর উত্তর ছিল, “যদি এমন নেতা দেখাতে পারেন যিনি টাকা নেননি, আমি তাঁর দলে নাম লেখাব।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৫
Share:

সাংবাদিকদের মুখোমুখি আসিফ। বিমানবন্দরের বাইরে।-নিজস্ব চিত্র

কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নয়, মুখ্যমন্ত্রীকে একেবারে ‘ডাকাতরানি’ বলে তোপ দেগে বসলেন আসিফ খান।

Advertisement

এর আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারদা কেলেঙ্কারিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। মমতা ‘মিথ্যাবাদী’ বলে অভিযোগ করেছিলেন। সারদার টাকা তৃণমূলে কারা নিয়েছেন প্রশ্ন করায় এর আগে তাঁর উত্তর ছিল, “যদি এমন নেতা দেখাতে পারেন যিনি টাকা নেননি, আমি তাঁর দলে নাম লেখাব।” কৌশলী সুরে বলেছিলেন, “তৃণমূল দলটা মমতার সন্তানের মতো। সন্তানের বাড়বৃদ্ধি হলে মায়েরও ভাল হয়!’’

সোমবার কিন্তু মুখের আগল পুরোপুরি খুলেই দিলেন আসিফ। পুলিশি প্রহরায় দমদম বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে দিব্যি ঠান্ডা মাথায় সাংবাদিকদের কাছে দাবি করলেন, “ডাকাতরানির দলের সবাই টাকা নিয়েছে।” ‘ডাকাতরানি’ কে? আসিফের জবাব এল, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”

Advertisement

মুকুল রায়ের প্রাক্তন ছায়াসঙ্গী এর আগে ধারাবাহিক ভাবে বিস্ফোরক মন্তব্য করে এসেছেন বটে। কিন্তু এমন বোমা যে আসতে চলেছে এ দিন, সেটা সম্ভবত আঁচ করেননি কেউই। প্রকাশ্যে কেউ বিষয়টা তেমন আমল না-দিলেও দলের অন্দরে এ নিয়ে একটা চাপা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের সামনে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নামে এত বড় একটা কথা বলার সাহস আসিফ পেলেন কী করে, সেটাই দলের একটা বড় অংশকে ভাবাচ্ছে।

সবিস্তার দ্খতে ক্লিক করুন...

তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতা নিজে ঘনিষ্ঠ মহলে মন্তব্য করেছেন, “ও (আসিফ) সবচেয়ে বড় ডাকাত।” কিন্তু লক্ষণীয় হল, সাংবাদিকদের সামনে মুখ খোলার সময় এ দিন আসিফকে বিন্দুমাত্র বাধা দেয়নি পুলিশ। এর আগে ধৃত সাংসদ কুণাল ঘোষ মুখ খুলতে গেলে ঠেকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছে তারা। কখনও জোর করে কুণালকে ভ্যানে তুলেছে। কখনও আবার ‘হা রে রে রে’ চিৎকার করে বা ভ্যান পিটিয়ে চেষ্টা করেছে তাঁর গলার স্বর চাপা দেওয়ার। অথচ এ দিন আসিফের ক্ষেত্রে তারা ছিল বিস্ময়কর ভাবে নিষ্ক্রিয়।

এ দিন সকাল পৌনে ৯টায় আসিফকে নিয়ে উত্তরপ্রদেশ রওনা হন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অফিসারেরা। তার আগে ভোরে নিউটাউন থানা থেকে তাঁকে আনা হয় বিমানবন্দর থানায়। উড়ান ধরার জন্য সকাল ৮টায় সেই থানা থেকে বেরিয়েই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আসিফ। পরে বিমানবন্দরে ঢোকার মুখেও ফের মুখ খোলেন তিনি। দু’বারই তাঁর অভিযোগের আঙুল ছিল মুখ্যমন্ত্রী এবং মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে। রীতিমতো ধীরেসুস্থেই তাঁকে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দেয় পুলিশ।

আসিফ এ দিন অভিযোগ করেন, বিধাননগর কমিশনারেট তাঁর যে ফ্ল্যাটটি বাজেয়াপ্ত করেছে, সেটি ‘অলিখিত ভাবে’ আসলে মুকুল রায়ের ফ্ল্যাট। আসিফের দাবি, “মুকুলদা ফুর্তি করতেন ওখানে।” ২০ কোটি ও ৮ কোটি টাকার যে দু’টি প্রতারণা মামলা দায়ের হয়েছে তাঁর নামে, সেগুলো সাজানো মামলা বলে বরাবরই অভিযোগ করে আসছেন আসিফ। তাঁর বক্তব্য, সারদা নিয়ে মুখ বন্ধ করার জন্যই তাঁকে পরিকল্পিত ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। তা হলে তাঁর অ্যাকাউন্টে যে বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে, সেগুলো কীসের? আসিফের উত্তর, “সব মুকুল রায়ের টাকা।”

তদন্তের জন্য যে রাজ্যে এ দিন আসিফকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যে রাজ্যে এক সময় তৃণমূল তাঁকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক করেছিল, সেই উত্তরপ্রদেশে মুকুলের হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে বলে তাঁর দাবি। “উত্তরপ্রদেশে মুকুল রায়ের যে টাকা রয়েছে, বাজেয়াপ্ত করে দেখাক পুলিশ,” বলেছেন আসিফ। এত টাকা কোথা থেকে আসত? আসিফের উত্তর, “সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে।” আসিফের অভিযোগ, যে সব ব্যক্তি এখন তাঁর নামে রাজারহাটে জমি নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ আনছেন, সেই ওয়াইদুল হাসান সিদ্দিকি বা রাজারাম শরাফও সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তা হলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করল কেন? আসিফ ফের আক্রমণাত্মক, “সব মুকুল রায়ের সাজানো গল্প।”

রাজারাম শরাফের প্রতারণা মামলায় আসিফকে গ্রেফতার করেছে বিধাননগর কমিশনারেট। সিদ্দিকির দায়ের করা মামলায় আসিফের আগাম জামিন রয়েছে। এ দিন অবশ্য সিদ্দিকির মামলার তদন্তেই আসিফকে উত্তরপ্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে কোথায় মুকুল রায় তাঁর টাকা লগ্নি করেছেন? সে উত্তর অবশ্য আসিফের কাছ থেকে মেলেনি।

আসিফের চাঁছাছোলা সব কথার উত্তরে এ দিন প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি মমতা। যদিও তৃণমূল সূত্রের খবর, ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, “আসিফ তৃণমূলের কেউ নয়। এক সাংবাদিক ওকে নিয়ে এসেছিল। ও টাকা রাখতে সিঙ্গাপুর গিয়েছিল। ও সবচেয়ে বড় ডাকাত। সংবাদমাধ্যম ওকে হিরো বানাচ্ছে।”

অস্বস্তিতে পড়লে অভিযুক্তকে ঝেড়ে ফেলার ট্র্যাডিশন তৃণমূলে নতুন নয়। সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরে মমতা নিজেই দলের কর্মিসভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কুণাল চোর?!’ কিন্তু সেই কুণালই তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার পরে তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে সময় নেননি মমতা। একই ঘটনা ঘটেছে সারদা কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হওয়া রজত মজুমদারের ক্ষেত্রে। তিনি ছিলেন দলের সহ সভাপতি। অথচ তাঁর গ্রেফতারির পরে তৃণমূলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অম্লান বদনে বলেছেন, ‘উনি দলের কেউ নন।’

গ্রেফতার হওয়ার আগে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিস্তর নথিপত্র নিজেই সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছেন আসিফ। তাঁকে উত্তরপ্রদেশের তৃণমূল পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করে যে চিঠি মুকুল রায় দিয়েছিলেন, দেখিয়েছিলেন সেটিও। একটি সংবাদপত্র অফিসে মুকুল ও তাঁর ছেলের সঙ্গে আসিফের বৈঠকের ছবি এর আগে প্রকাশিত হয়েছে। এ দিন পাওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি অনুষ্ঠানে মমতার খুবই কাছাকাছি উপস্থিত আসিফ।

যদিও মুখ্যমন্ত্রীর সুরেই আসিফের অভিযোগ উড়িয়ে তাঁর প্রাক্তন গডফাদার মুকুল রায় ঘনিষ্ঠ মহলে বলেন, “এক জন যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে। এ সবের প্রমাণ আছে?” কলকাতায় মুখ খুলেছেন কেবল দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আসিফের বোমার উত্তরে ছকে বাঁধা সুরে তাঁর জবাব, “মুখ্যমন্ত্রী তো জনসভায় বলেছেন, সারদা থেকে আমাদের দলের কেউ টাকা নেয়নি। সারদা-কাণ্ডে আমাদের দলের কেউ জড়িত নয়। এই বিষয়ে আমাদের দলের অবস্থান মুখ্যমন্ত্রীই স্পষ্ট করে দিয়েছেন।”

কিন্তু দলের অভ্যন্তরে আসিফের মন্তব্য নিয়ে যথেষ্ট তোলপাড় হচ্ছে। দলের এক শীর্ষ স্তরের নেতা জানান, আসিফের কথা শুনে অনেকেরই মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। নেতা-কর্মীদের অনেকেরই প্রশ্ন, “আসিফ এত সাহস পেল কী ভাবে? তবে কি দলের কেউ ওকে দিয়ে এ সব বলাচ্ছে?” সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ডাকাতরানি’ বলে আক্রমণ করা সহজ ব্যাপার নয়। এর আগে বফর্স মামলার সময় দেখা গিয়েছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম করে বিরোধীরা স্লোগান তুলছেন, ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গাঁধী চোর হ্যায়’! সেটা তবু ছিল রাজনৈতিক স্লোগান। আসিফের মতো কোনও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন মন্তব্য করা আদৌ শুধু ব্যক্তিগত হিম্মতে সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন থাকছেই।

তৃণমূল নেতৃত্বের মুখেও এ দিন বফর্স মামলার কথাই উঠে এসেছে। বফর্স কেলেঙ্কারিতে রাজীবের ভূমিকা প্রমাণ হওয়ার আগেই দলের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছিল। তৃণমূলের অনেকেও মনে করছেন, সারদায় কী প্রমাণ হল বা হল না-র চেয়ে ভাবমূর্তির গায়ে কালি লাগাটাই বড় ক্ষতি। বফর্স-এর প্রসঙ্গ টেনেই তৃণমূলের প্রথম সারির এক নেতা বলেন, “ওই নিয়েও তো প্রমাণ ছিল না। তবু একটা সরকার পড়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক কয়লা বণ্টন মামলায় কে কতটা দোষী, তা প্রমাণিত হওয়ার আগেই কংগ্রেসের আসন ৪৪-এ ঠেকেছে।” আর এক নেতার কথায়, “প্রমাণটা সব সময় বড় কথা নয়। আমরা সরকারে আছি। আমাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ দাখিল করা কি এত সহজ? কিন্তু মানুষ এত তথ্য-প্রমাণের ধার ধারে না! আমাদের গায়ে সারদার যে কালি লেগেছে, তা মোছা কঠিন।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement