অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
বৃহল্লাঙ্গুলদের সঙ্গে রাক্ষসকুলের হাতাহাতির একটা নজির রামায়ণে রয়েছে বটে, তবে ওই পর্যন্ত। মনুষ্যকুলের সঙ্গে তাদের ‘লড়াই’য়ের উল্লেখ তেমন চোখে পড়ে না।
পরস্পররের ভাষা না-বুঝে, মানুষ বনাম বাঁদর— এ-ওর দিকে, দাঁত খিঁচুনি, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে থাকলেও দু’পক্ষের হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ার নজির এত দিন ছিল না বললেই চলে। শুক্রবার, সে সব ইতিহাস উজিয়ে লাটাগুড়ি অবাক হয়ে দেখল— বাঁদরদের রে রে করে কর্তব্যরত সরকারি কর্মচারীদের আক্রমণের ঘটনা।
মাস কয়েক ধরে, কখনও থানা ঘেরাও করে কখনও বা গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশের গাড়ি থামিয়ে অপরাধী ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছে আমাদের। উত্তরবঙ্গের গরুমারা জাতীয় উদ্যান ঘেঁষা লাটাগুড়িতে এ দিন প্রায় সেই পথেই, বন দফতরের খাঁচায় ধরা পড়া সগোত্রীয় চার ‘রেসাস মাঙ্কি’কে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল প্রায় শ’খানেক বাঁদর। ঘটনাটি অবাক করে দিয়েছে বনকর্মীদেরও। বাঁদরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে, ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে ছুটে কোনও ক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচা এক বনকর্মী বলছেন, ‘‘এত বছর পাহাড়-জঙ্গলে কাজ করছি, গোবেচারা মুখ করে ঘুরে বেড়ানো রেসাস মাঙ্কিদের যে এমন দাপট হতে পারে, ভাবিনি।’’ আটপৌরে বাঁদরকুলের এমন মারমুখী হাবভাব দেখে কি়ঞ্চিৎ হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন লাটাগুড়ির স্থানীয় বাসিন্দারাও।
এর বাগানের লেবু, তো ওর বাগানের পেঁপে— খেত-বাগানে বাঁদরের দৌরাত্ম্য কম দেখেনি লাটাগুড়ি। তা নিয়ে মাস কয়েক ধরে বন দফতরের কাছে নালিশও জানিয়ে আসছিলেন তাঁরা। এ দিন বনকর্মীরা তাই ওই এলাকায় পর পর কয়েকটা খাঁচা বসিয়ে ছিলেন। বেলা বাড়তেই চেনা রুটিন মেনে জঙ্গল থেকে বাঁদরের দলটাও এসে পড়েছিল লাটাগুড়ির লোকালয়ে। বনকর্মীরা জানান, প্রায় শ’খানেক বাঁদরের দলটা স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের পাঁচিল টপকে পিছনে পুকুর পাড় ধরে চলে
এসেছিল আবাদি জমিতে। খাঁচাগুলি পাতা ছিল সেখানেই।
দলের অন্যরা দ্বিধা করলেও চারটি বাঁদর, খাঁচার ভিতরে টসটসে হলুদ রঙের মালভোগ কলা দেখে আর লোভ সামলাতে পারেনি। ধরা পড়তেও সময় লাগেনি। কলার ছড়ায় হাত দিতেই ঝপ করে পড়ে যায় খাঁচার দরজা। তাদের আর্ত চিৎকারে প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনি সঙ্গীরা। কিন্তু সগোত্রীয়রা আটকে পড়েছে বুঝতে পেরেই গোটা দলটা ঘিরে ধরে খাঁচা। তীব্র চিৎকার করে খাঁচার গারদ ঝাঁকিয়ে সঙ্গীদের ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা শুরু করে তারা। ব্যাপারটা খানিক উপভোগ করে এ বার নিছকই লাঠি হাতে তাদের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন বনকর্মীরা। বিপত্তিটা ঘটে তখনই। উর্দিধারীদের দিকে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আক্রমণ করে শ’খানেক বাঁদরের দলটা। গরুমারার ডিএফও সুমিতা ঘটক বলেন, ‘‘অতগুলো বাঁদর যে অমন মারমুখী হয়ে উঠতে পারে কর্মীরা ধারণা করতে পারেননি। তবে ভাগ্য ভাল কোনও কর্মী আহত হননি। আটক বাঁদরগুলোকে পরে অবশ্য গরুমারার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’’
ভারতীয় উপ-মহাদেশে রেসাস মাঙ্কি বা সাধারণ মেনি বাঁদর নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করছেন দেহরাদূনের ডব্লুটিআই-এর এস নারায়ণমূর্ত্তি। তিনি অবশ্য এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখছেন না। তিনি জানান, সগোত্রীয়রা বিপদে পড়লে এমনটা করেই থাকে কম-বেশি সব প্রাণীই। হাতিদের ক্ষেত্রেও এ নজির রয়েছে। আফ্রিকার সিংহ, বুনো কুকুর, বেবুনকেও সঙ্গীদের পাশে এমন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে
দেখা গিয়েছে। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘বেনারস এবং ইনদওরে সঙ্গীদের বাঁচাতে রেসাস মাঙ্কিদের এমন দলগত ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার বেশ কয়েকটি নজির রয়েছে।’’ লাটাগুড়ির পরিবেশপ্রেমী অনির্বাণ মজুমদার বলছেন, ‘‘বার বার আক্রমণ হয়তো করবে না ওরা, তবে লাটাগুড়ির বাঁদর-সমস্যার এ ভাবে সমাধান খোঁজা বোকামি। কারণ, বাঁদর নয়, আমরাই ওদের এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছি।’’ এবং তারপরেও গ্রেফতার?
পাল্টা আঘাত তো তা হলে আসতেই পারে!