গড়িয়াহাটে স্কুলছাত্রীদের বিক্ষোভ। —নিজস্ব চিত্র।
এক জনই? নাকি একাধিক?
আর জি কর কাণ্ডে ময়না তদন্তের রিপোর্টের সূত্র ধরে ফের কিছু প্রশ্ন সামনে আসছে। কলকাতা পুলিশ প্রথম থেকেই দাবি করছিল, চিকিৎসক খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় এক জনই জড়িত। তবে শহরের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের বড় অংশই এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। উল্টে তাঁদের প্রশ্ন, এক জনের পক্ষে কী করে একই সময়ে কারও নাক-মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ এবং গলা টিপে খুন করা সম্ভব? কী করেই বা এই সমস্ত কিছুর পরে ধর্ষণ করে সে ৩০ মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে যায়? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে, এমনটা সম্ভব, তা হলে মৃতদেহে এত আঘাতের চিহ্ন কেন? ঘুমের মধ্যেও যদি কেউ খুন হন, তা হলে তিনি প্রতিরোধের চেষ্টা করবেন কখন?
ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, তরুণীর শরীরে মোট ২৫টি আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। এর মধ্যে ১৬টি শরীরের বাইরের অংশে। ৯টি ভিতরে, যা ব্যবচ্ছেদের পরে পাওয়া গিয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে লেখা হয়েছে, তরুণীর মৃত্যু হয়েছে গলা টিপে এবং নাক-মুখ চেপে ধরে। দীর্ঘ দিন কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্তের কাজে যুক্ত এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে, হয় গলা টিপে ধরা, নয়তো নাক-মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করা। এ ক্ষেত্রে দু’টোই করা হয়েছে বলে ময়না তদন্তে উঠে এসেছে। এটা কী করে সম্ভব? এক জন একই সময়ে গলা টিপছে, আবার নাক-মুখও চেপে ধরছে— সেটা ধরে নেওয়া কঠিন। তর্কের খাতিয়ে যদি ধরেও নেওয়া যায়, এই ঘটনায় একমাত্র ধৃত ব্যক্তি সঞ্জয় রায় এক হাতে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা তরুণীর গলা টিপে ধরেছিল এবং আর এক হাতে নাক-মুখ চেপে ধরেছিল, তা হলে তরুণীর তো হাত-পা খোলা থাকছে। সেই অবস্থায় তো তিনি প্রবল প্রতিরোধের চেষ্টা করবেন। ধাক্কা দেবেন, নয়তো লাথি মারতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কি সে সবের কিছুই হয়নি? এক জন গলা টিপলে, অন্য জন নাক-মুখ চেপে ধরলে এবং অন্যরা হাত-পা ধরে থাকলে এমন ঘটনা বেশি বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে ঘটানো যায়।’’ ময়না তদন্তের সঙ্গে যুক্ত থাকা আর এক চিকিৎসকের দাবি, ‘‘ফরেন্সিক বিজ্ঞান অনুযায়ী কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু দেখতে হবে কোনটা ঘটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য। এ ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলের কোনও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নেই। নেই সরাসরি সাক্ষীও। তাই যুক্তি দিয়ে যেটা ঘটা সম্ভব মনে হয়, সেটাই বেশি বিশ্বাসযোগ্য ধরতে হবে।’’ পুলিশ যদিও এ ক্ষেত্রে দাবি করেছে, ধৃতের পিঠে আঁচড়ের দাগ মিলেছে। কিন্তু প্রতিরোধের চেষ্টা হিসাবে ধৃতের শরীরে আরও অনেক চিহ্নই থাকার কথা, দাবি ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের।
তাই তাঁদের বক্তব্য, ময়না তদন্তের রিপোর্ট করার জন্য যা যা মানতে হয়, তার অনেক কিছুই এ ক্ষেত্রে মানা হয়নি। কোন কোন জিনিস ‘বায়োলজিক্যাল ফরেন্সিক পরীক্ষা’র জন্য পাঠানো হয়েছে, তার উল্লেখ নেই রিপোর্টে। এমন কিছু শব্দবন্ধ এই রিপোর্টে লেখা হয়েছে, যা সাধারণত ব্যবহার হয় না। এই রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে কিছুটা তাড়াহুড়ো এবং যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁদের কিছুটা অভিজ্ঞতাহীনতা ফুটে উঠছে বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের। কলকাতা পুলিশের অবশ্য দাবি, তিন ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ছাড়াও ঘটনাস্থলে আরও তিন চিকিৎসক ছিলেন। ফলে ময়না তদন্তের রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকারই কথা নয়।
ময়না তদন্তের রিপোর্টে ধর্ষণ হয়েছিল কি না, সে ব্যাপারে যে ভাবে লেখা হয়েছে, সেই নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। রিপোর্টে লেখা হয়েছে, নির্যাতিতার ‘এন্ডোসার্ভাইক্যাল ক্যানাল’ (জরায়ুর অনেকটাই ভিতরের অংশ) থেকে ‘সাদা ঘন চটচটে তরল’ সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সেই তরল কী, তার উল্লেখ নেই রিপোর্টে। ‘এক্সটারনাল ও ইন্টারনাল জেনিটালিয়া’ (যৌনাঙ্গ)-র ওজন লেখা হয়েছে, ‘১৫১ গ্রাম’। ময়না তদন্তের রিপোর্টে নিয়ম মেনে মৃতদেহের বিভিন্ন অংশের ওজন উল্লেখ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ‘‘এই ওজন কোনও ভাবেই তরুণীর শরীরে পাওয়া সেমিনাল ফ্লুইডের ওজন নয়। সেমিনাল ফ্লুইডে কতটা বীর্য এবং কত জনের বীর্য মিলেছে, সেটা ফরেন্সিক পরীক্ষার আগে এ ভাবে বলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ তরুণীর শরীর থেকে ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়ার যে তত্ত্ব ছড়ানো হয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণ ভুল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কী ভাবে ওজন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছুই লেখা হয়নি।’’ ময়না তদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তরুণীর ‘হাইমেন’ ছিঁড়ে গিয়েছিল। রক্ত এবং তরল মিশে যোনিপথে বেরিয়ে এসেছিল। যোনিপথে একাধিক আঘাতের চিহ্নও মিলেছে। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ‘‘ধর্ষণের প্রতিরোধ করার চিহ্ন এগুলো। সাধারণত মৃতদেহকে ধর্ষণ করলে এই ধরনের চিহ্ন পাওয়া যায় না।’’
তবে কি খুনের পরে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে যে তত্ত্ব জানানো হয়েছিল, তা ভুল? চিকিৎসকেদের দাবি, ময়না তদন্তের যে পরিকাঠামো এ দেশে রয়েছে, তাতে মৃত্যুর আগে এবং মৃত্যুর কিছুক্ষণের মধ্যে হওয়া ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। তাঁদের দাবি, ‘‘ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, একাধিক আঘাত এবং শ্বাসরোধ করে মৃত্যু যখন প্রায় নিশ্চিত, তখনই ধর্ষণ করা হয়ে থাকতে পারে এ ক্ষেত্রে।’’ কিন্তু এত আঘাত এবং ধর্ষণ করে একজনের পক্ষে এ ভাবে চলে যাওয়া খুব কঠিন, মত বিশেষজ্ঞদের। এর সঙ্গেই তাঁরা যুক্ত করছেন, এই ঘটনায় এক মাত্র ধৃত সঞ্জয়ের শারীরিক গঠনের প্রসঙ্গ। তাঁদের দাবি, তদন্তে প্রথমে উঠে এসেছিল, একাধিক যৌনপল্লি ঘুরে আকণ্ঠ মত্ত অবস্থায় সঞ্জয় সেমিনার রুম-এ ঢুকেছিল। ফলে তার কাহিল হয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। সঞ্জয়ের মতো চেহারার এক জন পুরুষ একাই কাহিল এবং মত্ত অবস্থায় ৩১ বছরের একজন সুস্থ-সবল তরুণীর সঙ্গে এত কিছু করে ৩০ মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে যেতে পারে? রহস্যের জাল কাটার চেষ্টায় সিবিআই।