রোগ নয়, জীবনটাই সারিয়ে তুলছেন ওঁরা

পিন্টু লায়েক বড়লোক নন, প্রভাবশালী নন, কোনও নেতা-মন্ত্রীর আত্মীয়-পড়শি-পরিচিত নন। তিনি এক দরিদ্র গ্রামবাসী, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে দিন গুজরান করতেন। দুর্ঘটনায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে জীবনটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। আলো ফিরিয়ে আনলেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীরাই।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:২৪
Share:

অস্ত্রোপচারের পর পিন্টুর সঙ্গে স্ত্রী-কন্যা। রয়েছেন সনাতন সাহা (দাঁড়িয়ে)। —নিজস্ব চিত্র।

পিন্টু লায়েক বড়লোক নন, প্রভাবশালী নন, কোনও নেতা-মন্ত্রীর আত্মীয়-পড়শি-পরিচিত নন। তিনি এক দরিদ্র গ্রামবাসী, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে দিন গুজরান করতেন। দুর্ঘটনায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে জীবনটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। আলো ফিরিয়ে আনলেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীরাই।

Advertisement

হতদরিদ্র পিন্টু। বয়স বছর আটত্রিশ। থাকেন পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা-র কানুরাম গ্রামে একটা নালার ধারে প্লাস্টিকের ছাউনির নীচে। আপনজন বলতে স্ত্রী পুটকি আর দুই মেয়ে। বড়টির বয়স পাঁচ আর ছোটটি সবে চার মাস। স্ত্রী মানসিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন। কিছু মনে রাখতে পারছেন না, ভাল করে কথা বলতে পারছেন না। কোলের শিশুকে দুধও খাওয়াতে পারছেন না। শুধু ভয়-ভয় চোখে চারদিকে তাকাচ্ছেন।

এহেন পিন্টু লায়েক বাড়ি তৈরির কাজ করতে গিয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর পড়ে যান। তাঁর কোমর ভেঙে যায় এবং শিরদাঁড়ায় মারাত্মক আঘাত লেগে বেশ কয়েকটি হাড় ভাঙে। বুকের তলা থেকে শরীরের বাকি অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। সঞ্চয়ের আটশো টাকা সম্বল করে পাড়ার কিছু লোককে ধরে বউ আর কোলের বাচ্চাটিকে নিয়ে স্ট্রেচারে শুয়েই ৩০ সেপ্টেম্বর এসএসকেএমে এসে পৌঁছেছিলেন পিন্টু। হাসপাতালে তাঁদের ওই অবস্থায় ফেলে রেখে আটশো টাকা নিয়ে চম্পট দেয় পাড়ার লোকে। ঠিক সেই সময়েই চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্মীরা হাল ধরেছেন পিন্টুর পরিবারের। শুধুমাত্র চিকিৎসা নয়, কার্যত হাসপাতালের প্রয়াসেই পরিবারের চার-চারটি মানুষ বেঁচে গিয়েছেন। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে পিন্টু বলছিলেন, ‘‘জীবনে কখনও কারও একটু যত্ন, একটু সাহায্য পাইনি। সবাই তাড়িয়ে দিয়েছে, গালি দিয়েছে। যা ছিল, তাও কেড়ে নিয়েছে। আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না কী করে আমার সঙ্গে এত ভাল ভাল সব হতে পারে!’’

Advertisement

পিজি হাসপাতাল চত্বরে পিন্টুর স্ত্রীকে বাচ্চা কোলে এলোমেলো ঘুরতে দেখে এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী তাঁকে সুপারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, তাঁর চোখে পড়েছিল অপরিচিত কিছু মুখ পুটকির চারপাশে সন্দেহজনক ভাবে ভিড় করছে। সুপার করবী বড়ালের কথায়, ‘‘মেয়েটি কিছুই বলতে পারছিল না। শুধু কাঁপছিল। ওর কোলের বাচ্চাটা অপুষ্ট, অসুস্থ ছিল। অনেক কষ্টে ওর কাছ থেকে পিন্টুর কথা জানা যায়। হাসপাতাল চত্বরে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে পিন্টুর স্ট্রেচার মেলার পর তাঁকে ভর্তি করা হয় বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি’র নিউরোসার্জারি বিভাগে।’’

শুধু পিন্টুর চিকিৎসা নয়— হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকদের একটা অংশ বুঝতে পারেন, গোটা পরিবারটিরই পুনর্বাসন দরকার। রোগীর মহিলা আত্মীয়দের জন্য তৈরি আশ্রয়স্থলে পুটকির থাকার ব্যবস্থা করেন কর্তৃপক্ষ। তাঁর বাচ্চাটিকে ভর্তি করা হয় নিওনেটোলজিতে। এখনও সে ওখানেই রয়েছে। মাতৃদুগ্ধ ব্যাঙ্ক থেকে দুধ নিয়ে তাকে খাওয়ানো হচ্ছে। সকাল-বিকেল পুটকির খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে হাসপাতালের রান্নাঘর থেকে। ওই রান্নাঘরেরই এক কর্মী বিমলেন্দু মান্না-র বাড়িও ডেবরাতে। তাঁকে কানুরাম গ্রামে পাঠিয়ে পিন্টু-পুটকির বড় মেয়ে প্রতিবেশীদের কাছে নিরাপদে রয়েছে কিনা, সেই খবরও আনা হয়েছে।

গত ১৮ অক্টোবর পিন্টু-র অস্ত্রোপচার করেছেন চিকিৎসক শুভাশিস ঘোষ। রোগীর স্ত্রী-র মানসিক অবস্থা যেহেতু পুরোপুরি ঠিক নেই, তাই অস্ত্রোপচারের আগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সই করতে এগিয়ে আসেন এসএসকেএমের অস্থায়ী নাপিত হিসাবে কাজ করা সনাতন সাহা। শুধু তাই নয়, অস্ত্রোপচারের জন্য দু’ইউনিট রক্তের প্রয়োজন ছিল। সেই রক্তও দেন সনাতনবাবু। পুজোর সময় পিন্টু-পুটকি আর তাঁদের মেয়েকে নতুন জামাকাপড়ও কিনে দিয়েছেন তিনি।

পিন্টু লায়েক এখন উঠে বসতে পারছেন। ঘটনাটি জানার পর মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁকে একটা হুইলচেয়ার দেওয়া হচ্ছে। অ্যাম্বুল্যান্সে তাঁকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও পাকা। এসএসকেএমের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান অরূপ বিশ্বাসের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কাজ করতে বলেন। মানবিক হতে বলেন। হাসপাতাল যে সেটা করে দেখাতে পেরেছে, এর বেশি আর কী চাই!’’ পরবর্তী কালে পিন্টুর পরিবারের অন্নসংস্থানের কী ব্যবস্থা করা যায়, তা নিয়ে অরূপবাবুর সঙ্গে কানুরাম গ্রাম পঞ্চায়েতের কথা চলছে। পঞ্চায়েত প্রধান সিপিএমের শিবু সিংহ-ও জানালেন, পুটকির জন্য একশো দিনের কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না, দেখা হচ্ছে। ব্যবস্থা হচ্ছে আর্থিক অনুদানেরও। তৃপ্ত গলায় রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘সরকারি হাসপাতাল নিয়ে এত সমালোচনা, এত নেই-নেই। আমরা যে অনেক ভাল কাজও করি সেটা এ বার দেখলেন তো!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement