এক রাতেই বড় হয়ে গেল বালিকা ফিরোজা

ভিড় থেকে ভাইকে টেনে এনে মাঝে মাঝে চৌকির উপর বসিয়ে দিচ্ছে বটে, কিন্তু মিনিট কয়েকের মধ্যেই সাত মাসের ছটফটে ইস্তাককে ফের আবিষ্কার করা যাচ্ছে সেই খোলা উঠোনে।

Advertisement

বিমান হাজরা

বাহালনগর শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৪৪
Share:

নিহত নইমুদ্দিন শেখের শোকার্ত পরিজন। বুধবার বাহালনগরে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

রফিকুল শেখের সাত মাসের ছেলে সবে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। পাড়াপড়শির ভিড়ের ফাঁকে উঠোনময় এলোমেলো হামা দিয়ে বেড়াচ্ছে সে। সে দিকে কারও অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই। পাঁচ বছরের মেয়ে ফিরোজাই এখন তার অভিভাবক। এক রাতেই যেন বড় হয়ে গেছে মেয়েটি!

Advertisement

ভিড় থেকে ভাইকে টেনে এনে মাঝে মাঝে চৌকির উপর বসিয়ে দিচ্ছে বটে, কিন্তু মিনিট কয়েকের মধ্যেই সাত মাসের ছটফটে ইস্তাককে ফের আবিষ্কার করা যাচ্ছে সেই খোলা উঠোনে। তাদের মা, মাবিয়া বিবি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। পড়শি মহিলার কোলে মাথা রেখে অনর্গল বিড়বিড় করে চলেছেন, ‘‘এমনটা কেন অইল গো, কী দোষ করসিলাম!’’

পাশের বাড়িটি কামিরুদ্দিন শেখের। দু’বাড়ির মাঝে একটা মস্ত পাকুড় গাছ। তার ছায়ায় বুধবার সকাল থেকে চাক বেঁধে আছে ভিড়। সে বাড়ির উঠোনের এক কোণে পড়ে আছে তাঁর লছিমন (মোটরচালিত তিন চাকার ভ্যান)। কামিরুদ্দিনের মা এসরা বেওয়া বুক চাপড়ে কাঁদছেন, ‘‘ওই লছিমনডা চালায়েই তো সংসারটা টানতে পারতিস বাবা, কেন যে কাশ্মীর গেলি!’’

Advertisement

স্বজনহারা: কুলগামে জঙ্গি হামলায় নিহত কামিরুদ্দিন শেখের মেয়ে এবং স্ত্রী। বুধবার মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির বাহালনগরে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

মোড়গ্রাম সেতু পার করেই জাতীয় সড়ক থেকে ভাঙাচোরা রাস্তাটা সটান নেমেছে গ্রামের দিকে। খানিক এগোলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার তিনেক কাঁচা-পাকা বাড়ি, বাহালনগর। মুর্শিদাবাদের প্রায় অচেনা সেই গ্রাম বুধবার সকাল থেকে হাজারো গাড়ির গন্তব্য হয়ে উঠেছে। ধুলোয় আবছা হয়ে আসা গ্রামের মোড়ে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ কাশেম আলি বলছেন, ‘‘আমাগো গ্রাম এত গাড়ি কখনও দেখে নাই!’’

কাশ্মীরের কাতরাসুতে জঙ্গি-গুলিতে এ গ্রামের পাঁচ শ্রমিকের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার খবর পৌঁছতেই সেই প্রান্তিক গ্রাম যেন দেশের মানচিত্রে একটা পরিচয় খুঁজে পেয়েছে! গ্রামবাসীরা বলছেন, ‘‘ভোটের সময় ছাড়া এ গ্রামে আর গাড়ি এল কবে!’’

শীত এসেছে। আলো পড়ে এলেই বাহালনগরের দোকানের ঝাঁপ পড়ে যায়। বটতলার মাচার আড্ডায় পাতলা হয়ে আসে ভিড়। একে একে নিভে যায় আলো। মঙ্গলবার তেমনই অন্ধকার বাহালগ্রামে পুলিশ এসে জানিয়ে গিয়েছিল জঙ্গি হানার খবর। গ্রামের স্কুল শিক্ষক কাদের আব্বাস বলছেন, ‘‘কোথায় কাশ্মীর আর কোথায় আমাদের গ্রাম। তবু দেখেন, দুঃসংবাদ কেমন উড়ে আসে যেন!’’

মঙ্গলবার, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময়ে ঘুমন্ত গ্রামকে জাগিয়ে পুলিশ জানিয়ে গিয়েছিল— কাশ্মীরের কাতরাসুতে গ্রামের পাঁচ জনকে জঙ্গিরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে গুলিতে। এক জন পালাতে পেরেছেন বটে, তবে গুলিতে তিনিও গুরুতর জখম। প্রাণে বাঁচলেও জহিরুদ্দিন শেখ আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুলগম হাসপাতালে ভর্তি। রাতভর গ্রামের দুয়ারে কড়া নেড়ে পুলিশ অতঃপর জানিয়ে গিয়েছিল মৃতের তালিকা— কামিরুদ্দিন শেখ (৩২), রফিকুল শেখ (২৮), রফিক শেখ (৩৫), মুরসালিম শেখ (৩৫) এবং নইমুদ্দিন শেখ (৩৮)। সাকিন, ব্লক সাগরদিঘি, বাহালনগর।

এরই মাঝে এক চিলতে সুখবর, মৃতদের সঙ্গে থাকা গ্রামেরই অন্য তিন যুবক অক্ষত রয়েছেন। বাড়ির লোকের সঙ্গে ফোনে এক দফা কথাও হয়েছে তাঁদের। সাদের সরকার তাঁদেরই এক জন। তাঁর বাড়ির সামনে উদ্বিগ্ন চোখে দাঁড়িয়ে আছেন দাদা নাদের সরকার। বলছেন, ‘‘বাড়িতে ওই তো একমাত্র রোজগেরে। এখানে কাজ না পেয়েই তো ভিন দ্যাশে গেছিল!’’

পাশের পাড়ার কামিরুদ্দিন শেখও বাড়ির এক মাত্র রোজগেরে ছিলেন। গ্রামেই লছিমন চালাতেন। চার ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী। সংসারে সামান্য বাড়তি আয়ের মুখ দেখতেই ২৬ দিন আগে গ্রামের অন্য কয়েক জনের সঙ্গে তিনিও পাড়ি দিয়েছিলেন কাশ্মীর। দশ বছর ধরে এ সময়ে ভূস্বর্গে পাড়ি দেওয়াটাই তাঁর দস্তুর। তাঁর মা এসরা বেওয়া বলছেন, “নাতনি কিডনির অসুখে ভুগতেছে। দু’টি রোজগারের আশায় সে জন্যই তো কামরুর কাশ্মীরে যাওয়া।’’

রফিক শেখের তিন মেয়ে। বিয়ের পর বছর ঘোরার আগেই বড় মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন বাবার কাছে। ইন্দিরা আবাস যোজনার এক ফালি বাড়ির উঠোনে বসে রফিকের স্ত্রী কামিরুন বিবি বলছেন, “এখন দিন চলবে কী ভাবে কিছুই জানি না। সব যে অন্ধকার!’’

রফিকুল শেখের স্ত্রী মাবিয়া বলছেন, “পরশু দিনই ফোনে কথা হইল, বলছিল ‘খুব গোলমাল, ভাল লাগে না। থাকা যাবে না আর।’ তা বলে লাশ হয়ে ফিরবে!’’

কিশোরবেলা থেকেই কাশ্মীরে যাচ্ছেন নৈমুদ্দিন শেখ। তাঁর ছেলে লালচাঁদ কাজ করেন কেরলে। মেয়ে নেসবানুর হাঁটুতে মাথা রেখে নাগাড়ে বলে চলেছেন, “আমার বাবার কী দোষ ছিল বলো তো। কাশ্মীর শান্ত বলেছিল সরকার। সেই ভরসাতেই তো গিয়েছিল আপেল বাগানে কাজ করতে। এই বুঝি শান্তির নমুনা!’’

মুরসালিমের পরিবারে ৭৫ বছরের বৃদ্ধ বাবা আমির হোসেনের প্রতি দিনের ওষুধের খরচ ১০০ টাকা। বাড়িতে মা, স্ত্রী দুই ছেলে মেয়ের সংসারে রোজগেরে ছিলেন তিনিই। বাবার কান্না থামতেই চাইছে না।

রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে উনুনে জল ঢেলে ঝাঁপ ফেলছেন সাকিব আলি, বলছেন, ‘‘সত্যি, আরও কত কী যে দেখতে হবে!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement