Government Land Encroachment

মমতা বলেছিলেন সরকারি জমি দখল হচ্ছে, হাওড়ায় তেমনই সরকারি জমিতে আস্ত এক কারখানার খোঁজ!

বালি জগাছা ব্লকে বিঘার পর বিঘা সরকারি জমিতে এমন গুদাম, কারখানা-সহ বিবিধ নির্মাণ মাথা তুলেছে। সেই গুদাম ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে। কোথাও বর্গ ফুট প্রতি ভাড়া ১০ টাকা, কোথাও ৮ টাকা।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৯:০০
Share:

দখল হওয়া জমিতে সরকারের বোর্ড লাগাচ্ছেন প্রশাসনিক আধিকারিকেরা। —নিজস্ব চিত্র।

সরকারি জমি দখল হওয়া নিয়ে সম্প্রতি নবান্নের একাধিক বৈঠক থেকে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খাসজমি দখলমুক্ত করতে প্রশাসনকে কড়া পদক্ষেপ করারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তার পরে সরকারি জমি চিহ্নিত করে সেখানে ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জমি’ লেখা বোর্ড লাগানো শুরু হয়েছে জেলায় জেলায়। এই অভিযান যখন চলছে, তখন হাওড়ায় সরকারি খাসজমিতে আস্ত কারখানা তৈরি হওয়ার ছবি এল আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে। শুধু কারখানাই নয়, গুদামও তৈরি হয়েছে সরকারি জমিতে। সেই গুদাম ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে। কোথাও বর্গ ফুট প্রতি ভাড়া ১০ টাকা, কোথাও ৮ টাকা।

Advertisement

বালি জগাছা ব্লকে বিঘার পর বিঘা সরকারি জমিতে এমন গুদাম, কারখানা-সহ বিবিধ নির্মাণ মাথা তুলেছে। মমতা তাঁর প্রশাসনিক বৈঠকেই বলেছিলেন, ভূমি ও ভূমিসংস্কার দফতরের এক শ্রেণির আধিকারিক এই জমি ‘বেহাত’ হওয়ার ঘটনায় যুক্ত। তাঁদের সঙ্গে পুলিশের একটি অংশেরও যে যোগ রয়েছে, তা-ও বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, শুধু সরকারি আধিকারিক এবং পুলিশের একাংশ নয়, শাসকদলের স্থানীয় স্তরের নেতারাও এর সঙ্গে যুক্ত।

—নিজস্ব চিত্র।

বালি পুরসভার যে অংশ লিলুয়া এলাকার মধ্যে পড়ে, সেখানেই এই দখল এবং বেআইনি নির্মাণ ‘ভয়ানক’ আকার নিয়েছে বলে প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য। প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কথার মধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, হাওড়ায় যে ‘মাৎস্যন্যায়’ চলছে, তা তিনি বরদাস্ত করবেন না। নবান্ন সূত্রের খবর, একদা যাঁরা মমতার ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহলে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের উপরেও মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। এখন যখন প্রশাসন পদক্ষেপ করা শুরু করেছে, তখন বালি এলাকায় দেখা যাচ্ছে প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা হাওড়া সদরের যুব তৃণমূল সভাপতি কৈলাস মিশ্র সঙ্গে থাকছেন। কেন? কৈলাস জানিয়েছেন, তিনি ‘নাগরিক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও প্রশাসনের অনেকে বলছেন, কৈলাসই বিষয়টি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে এবং মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে জানিয়েছিলেন। তাই অলিখিত ভাবে তিনিই প্রশাসনিক কর্তাদের পথপ্রদর্শক হয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, কোথায় কোথায় এমন দখল হয়েছে। কৈলাস নিজে অভিষেকের দফতরকে অবগত করানোর কথা মেনে নিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি অভিষেকদার অফিস এবং সিএম ম্যাডামের অফিসকে জানিয়েছিলাম।’’

Advertisement

কারা রয়েছে এর নেপথ্যে? এ ব্যাপারে কৈলাস কিছু বলতে চাননি। তবে তৃণমূলের অনেক নেতাই প্রাক্তন দুই কাউন্সিলরের নাম বলছেন ঘরোয়া আলোচনায়। কোটি কোটি টাকার ‘জমি সিন্ডিকেট’ চলছে বলে দাবি তাঁদের। এমনকি, ভূমিসংস্কার দফতরের নথিতেও সরকারি খাসজমি ব্যক্তিবিশেষের নামে রেজ়িস্ট্রেশন হয়ে গিয়েছে বলে দাবি শাসকদলেরই একটা অংশের। তাদের বক্তব্য, সরকারি আধিকারিকেরা নেপথ্যে না থাকলে এই ধরনের নথিভুক্তকরণ বা রেজিস্ট্রেশন সম্ভব নয়।

হাওড়ার জেলাশাসক দীপপ প্রিয়ার বক্তব্য, ‘‘প্রশাসনিক ভাবে পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। যাঁরা জমি দখল করে রেখেছেন, তাঁদের আমরা নোটিস পাঠানো শুরু করেছি।’’ বালির বিধায়ক তথা চিকিৎসক রানা চট্টোপাধ্যায়ের আবার দাবি, এই দখলের অনেকটাই শুরু হয়েছিল বাম জমানায়। তাঁর কথায়, ‘‘যা হয়েছে, তা সংশোধন করতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরেই প্রশাসন নেমে পড়েছে।’’ রানার এ-ও বক্তব্য, ‘‘ফাঁকা জায়গা ঘিরে অনেক সময়ে পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বোঝা যায়নি ভিতরে কী হচ্ছে।’’ যদিও বালি, বেলুড়, লিলুয়ার পশ্চিম পারের তৃণমূল নেতাদের অনেকেই ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, সরকারি জমি দখল লাগামহীন পর্যায়ে গিয়েছে ২০২১ সালের পর থেকে।

বালি-জগাছা ব্লকের বিএলআরও কৌশিক চক্রবর্তী যে ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না, প্রশাসনিক সভায় সে কথাও উল্লেখ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর এক্তিয়ারের অধীন এলাকায় এই রকম দখল অভিযান চলেছে, নির্মাণ হয়েছে, তিনি জানতেন না? কৌশিক সেই প্রশ্নের জবাব দেননি। তাঁর সীমিত বক্তব্য, ‘‘প্রশাসনিক ভাবে যা করার করা হচ্ছে। নোটিস পাঠানো হচ্ছে। পদক্ষেপের বিষয়ে সমস্তটাই জেলা প্রশাসন জানে।’’

উত্তর হাওড়ার এক তৃণমূল নেতার বক্তব্য, ‘‘বালিতে এই দখল সাংঘাতিক ভাবে হলেও এই চক্রের সঙ্গে শুধু বালির লোকজন যুক্ত নয়।’’ তিনি ইঙ্গিত করেছেন এক মন্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ কয়েক জনের বিরুদ্ধেও। সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে উত্তর হাওড়ার ওই নেতা এমনও বলেছেন যে, ‘‘পুকুর, ডোবা, কচুরিপানা, নর্দমা, মাঠ— কিচ্ছু বাদ নেই! হয় বুজিয়ে না হয় খুঁড়ে নির্মাণ তুলে দেওয়া হচ্ছে।’’ তবে বালি এলাকায় সরকারি জমি দখলমুক্ত করার অভিযানে যুবনেতা কৈলাস যে ভূমিকা নিচ্ছেন, যে ভাবে প্রশাসনকে সঙ্গত করছেন, তা নিয়ে শাসকদল ও প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।

মমতার ওই নির্দেশের পর থেকে প্রশাসন যে সক্রিয় হয়ে নেমেছে, তা সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে। তবে তৃণমূলের অনেক নেতাই ঘরোয় আলোচনায় বলছেন, এখনও এফআইআর দায়ের হচ্ছে না। সেটা যখন হতে শুরু করবে, তখনই আসল চক্র প্রকাশ্যে চলে আসবে। শাসকদলের অনেক নেতার বক্তব্য, বহু জায়গায় বিজেপি এবং সিপিএমের লোকজনও জমি সিন্ডিকেটে যুক্ত। অর্থাৎ সবই হচ্ছে মিলেজুলে। বোঝাপড়া করে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement