আহত মহিলা শ্রমিককে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। নিজস্ব চিত্র
লকডাউনে বন্ধ স্কুল। ভিন্ রাজ্যে শ্রমিক বাবা হয়ে পড়েছিলেন কর্মহীন। অভাব-অনটনের সংসার টানতে তাই প্লাস্টিক কারখানায় কাজে সুযোগটা হারাতে চায়নি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, ১৩ বছরের আজিজুর রহমান। কিন্তু সে উপার্জনের টানই কাল হল তার, বলছেন পরিজনেরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে মালদহ মেডিক্যাল কলেজের প্রাঙ্গণে বসে বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন তার মা ফতেমা বিবি। সুজাপুরে প্লাস্টিক কারখানায় বিস্ফোরণ কেড়ে নিয়েছে তাঁর ছেলেকে।
আজিজুরের বাবা মোস্তাফা এখন মুম্বইয়ে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, মোস্তাফার চার ছেলের মধ্যে আজিজুরই বড়। মৃতের আত্মীয় মিলি বিবি বলেন, “লকডাউনে বাড়িতেই বসেছিলেন মোস্তাফা। মাসখানেক আগে মুম্বইয়ে কাজের জন্য ডাক পান। এর মধ্যে স্কুল না থাকায় তাঁদের বড় ছেলে আজিজুর প্লাস্টিক কারখানায় মাত্র ১৮০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ শুরু করে। এমন দুর্ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা ভাবতেই পারছি না।” গ্রামের সেলিমা বিবি, রহিমা খাতুনেরা বলেন, “আজিজুর পড়াশোনায় বেশ ভাল ছাত্র ছিল। ক্লাসে তার রোল নম্বর ছিল ১২। এই অভাবের সংসারের হাল ফেরাতে গিয়ে যে এমন ভাবে চলে যাবে, তা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।”
এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ সুজাপুরে প্লাস্টিক কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে রাজীব খান (১৮), আজিজুর রহমান (১৩), আব্দুল রহমান (১৮), মোস্তাফা শেখ (৪০), সারিফুল শেখের (২৯) এবং আবু সায়েদ খান। আবু সায়েদ প্লাস্টিক কারখানার অন্যতম মালিক। তাঁকে মালদহে নিয়ে আসা হয় ময়না তদন্তের জন্য। আহত হয়েছেন পমিলা মণ্ডল, জুলি বেওয়া, জুলেখা বিবি, রেণুকা মণ্ডল, মুসা শেখ এবং বদিরুদ্দিন শেখ। আহতেরা ভর্তি রয়েছেন মালদহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, আহতদের শরীর ঝলসে গিয়েছে। দুই মহিলা এবং এক যুবকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাঁরা ঠিক মতো কথা বলতে পারছেন না।
এ দিন বিকেলে হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান রাজ্যসভার সাংসদ মৌসম নুর। মৃতদের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। মৌসম বলেন, “মৃত এবং আহতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করা হচ্ছে। আহতদের চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” সুজাপুরের কংগ্রেস বিধায়ক ইশা খান চৌধুরী দাবি করেন, ‘‘বিজেপি ওই শ্রমিকদের পরিবারে পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষতিপূরণের কথা না বলে উল্টো ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলছে। মানবিক কোন দৃষ্টিভঙ্গি নেই তাদের।’’ ইশার দাবি, মৃতদের পরিবার পিছু ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিক কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার।
এ দিনই মৃতদেহগুলির ময়নাতদন্ত হয়। মৃত রাজীব খানের বাবা সাহিদুর খান বলেন, “পড়াশোনা করতে না চাওয়ায় অষ্টম শ্রেণির পরেই প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ শুরু করে ছেলে। তার সাত মাসের এক সন্তানও রয়েছে। এ দিন সকালেও ছেলের সঙ্গে খেলা করে কাজে যায়।”
দশ বছর ধরে প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করছিলেন সারিফুল শেখ। তাঁর মামা করিম শেখ বলেন, “কাটিং মেশিন বিস্ফোরণ হয়ে মানুষ মারা যাবে, তা ভাবতেই অবাক লাগছে। কারণ, আমিও পাঁচ বছর ধরে প্লাস্টিকের কারখানায় একটানা কাজ করছি।” বিস্ফোরণের কারণ পরিবারের পাশাপাশি প্রকাশ্যে আনার দাবি জানিয়েছেন সুজাপুরবাসীও। তাঁদের দাবি, বিস্ফোরণে ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠেছিল সুজাপুরের একাংশ। সুজাপুরে দীর্ঘ সময় ধরে প্লাস্টিকের কারখানাগুলি চলছে। কখনও এমন হয়নি। তাই বিস্ফোরণের ঘটনা পুলিশের উচিত তদন্ত করে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা।
মালদহের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “ঘটনার শুরু হয়েছে।”