বিস্ফোরণস্থলের আশেপাশের বাড়ি কার্যত লন্ডভন্ড। নষ্ট হয়েছে বহু জিনিস। তারই মধ্যে কিছু আস্ত আছে কি না, সন্ধানে এক বাসিন্দা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
দত্তপুকুর কাণ্ডের পরে ৭২ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। কিন্তু বাজি কারখানা বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্তকারীরা। সব থেকে বড় প্রশ্ন, কারখানাটিতে বাজি তৈরি হত, নাকি বিস্ফোরক? সোমবার ঘটনাস্থল থেকে ঘুরে গিয়েছেন ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের কয়েক জন আধিকারিক। তাঁদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে অবশ্য ইঙ্গিত করা হয়েছে, কম তীব্রতার বিস্ফোরক মজুত থাকতে পারে ওই কারখানায়। জেলা পুলিশকর্তারা যদিও এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলতে চাইছেন না।
প্রশ্ন রয়েছে প্রধান অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা নিয়েও। প্রথম দু’দিনে মোটে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। স্থানীয় তৃণমূল নেতা ও বাজি ব্যবসায়ী আজিবর গাজি বিস্ফোরণের পর থেকেই পলাতক ছিলেন। এই আজিবরের বাড়ির পিছনের গুদাম থেকেই বাজি উদ্ধার করে পুলিশ। মঙ্গলবার আজিবরের বড় ছেলে আতিয়ার রহমান ও ভাইপো মতিয়ার রহমান বাড়িতে আসে। স্থানীয়েরা জানতে পেরে চড়াও হয় বাড়িতে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, উত্তেজিত জনতা ধরে ফেলে দু’জনকেই। তার পরে তাদের মারধরের চেষ্টা করা হয় বলেও অভিযোগ। সেই সময়ে নামে প্রবল বৃষ্টি। পুলিশ ও র্যাফ কাছেই ছিল। তারা দ্রুত এসে লাঠিচার্জ করে আতিয়ার ও মতিয়ারকে উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নেয়। কিন্তু স্থানীয়দের দাবি, আরও অনেক অভিযুক্তই এখনও অধরা।
পর্যবেক্ষকদের কথায়, মূল অভিযুক্তদের পাকড়াও করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারলে স্পষ্ট হবে না, কারখানায় ঠিক কী ছিল— বাজির মশলা না কি বোমা তৈরির রাসায়নিক। একই ভাবে এই বাজি এবং বোমা কোথায় যেত, এর সঙ্গে আরও কারা জড়িত, এর কিছুই জানা যাবে না। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, পুলিশ অভিযুক্তদের ধরতে ততটা সচেষ্ট নয়।
পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ মানেনি। তাদের বক্তব্য, তদন্ত চলছে। ঠিক সময়ে অভিযুক্তেরা ধরা পড়বে। পুলিশের একাংশের কথায়, এর মধ্যেই ফরেন্সিক এবং এনআইএ-র তদন্তকারীরা এসে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে গিয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে তদন্তকারীদের তরফেও। এর মধ্যে ফরেন্সিক তদন্তকারীদের সঙ্গে পুলিশের এক দফা কথাও হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মৌখিক ভাবে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা তীব্রতা কম যুক্ত বিস্ফোরক মজুতের দিকেই প্রাথমিক ইঙ্গিত করেছেন। বিস্ফোরণস্থল এবং চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাজির নমুনা সংগ্রহ করার পরে তা খতিয়ে দেখে প্রাথমিক ভাবে তাঁদের এটা মনে হয়েছে, দাবি পুলিশ সূত্রে। একই রকম সন্দেহ রয়েছে ঘটনাস্থলে ঘোরা একাধিক পুলিশকর্তাও। তদন্তকারী পুলিশকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছে, বাজি বা বাজি তৈরির মশলা থেকে বিস্ফোরণ হলে সে ক্ষেত্রে পাটের সুতলি, পোড়া দাগ থাকার কথা। মোচপোলে তেমন কিছু এখনও মেলেনি। ফলে জোরালো হচ্ছে বিস্ফোরক তত্ত্ব।
বারাসতের পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ফরেন্সিক রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত আমরা স্পষ্ট করে বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না।’’
কম তীব্রতা যুক্ত বিস্ফোরক বলতে কী বোঝায়? পুলিশের তদন্তকারী কর্তারা জানাচ্ছেন, বাজি বা বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘বাজি তৈরিতে যে বিস্ফোরক ২ গ্রাম ব্যবহার করা হয়, সেই একই বিস্ফোরক ২০০ গ্রাম ব্যবহার করলে বোমা তৈরি হয়। ২০-২৫টি বাজি একসঙ্গে করলেও বোমার আকার নেয়।’’ মোচপোলের সাধারণ গ্রামবাসী প্রথম থেকেই দাবি করেন, স্থানীয় ভাষায় যাকে আলু বাজি বা আলু বোমা বলা হয়, শুধু তার মশলা ফাটলে এত বড় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হত কি না সন্দেহ। স্থানীয় এক যুবকের কথায়, ‘‘পেটো বা বোমা আমরা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছি। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখানে বেআইনি বাজি তৈরির কারখানায় আলু বাজির আড়ালে বোমা তৈরি হত। দু’টো ক্ষেত্রে একই মশলা লাগে। তফাত একটাই— বাজিতে স্প্লিন্টার থাকে না, বোমায় থাকে।’’ রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, বিস্ফোরণের আগে, শনিবার রাতে গাড়িতে চাপিয়ে বেশ কয়েকটি ড্রাম আনা হয়। গুদামে রাখা হয় সে সব। সেগুলিতে বিস্ফোরক ছিল কি না, তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত নন তদন্তকারীরা। ওই ড্রামগুলি অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল কি না, তা নিয়েও স্পষ্ট নয়। এক তদন্তকারী আধিকারিক বলেন, ‘‘হতে পারে, বিস্ফোরক ভর্তি ড্রামগুলি ইটভাটার গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। গোটাটাই আমরা খতিয়ে দেখছি।’’ এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতেই ইটভাটার আড়ালে থাকা বাজির গবেষণাগার থেকে যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
এ দিকে, বিস্ফোরণের পরে নড়চড়ে বসেছে পুলিশ। ইছাপুর-নীলগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ গোটা দত্তপুকুর থানা এলাকার অনেক জায়গা থেকেই মজুত বেআইনি শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ২২০০ কেজি বেআইনি বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, জানিয়েছে জেলা পুলিশ। এ দিন বিস্ফোরণস্থল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে একটি গুদাম থেকে বস্তা ভর্তি বাজির মশলা ও বাজি উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসটিএফ সূত্রে খবর, পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজি সরাচ্ছেন বেশ কিছু ব্যবসায়ী। এমন খবর পেয়ে আমডাঙার বেড়াবেড়িয়া এলাকায় একটি ধর্মকাটায় ওঁত পেতে বাজি ভর্তি ট্রাক ধরে এসটিএফ। ট্রাকচালক সরিফ আলি ও বাজি ব্যবসায়ী বিমল ধারাকে গ্রেফতার করা হয়। এসটিএফ সূত্রের দাবি, তিন ট্রাক বাজি উত্তরবঙ্গের দিকে যাওয়ার রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ছিল।