হুমকি ও গালিগালাজ। মঙ্গলবার নজরুল মঞ্চে। নিজস্ব চিত্র।
প্রায় ছ’বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি রাজ্যের কলেজগুলিতে। নিয়ম মতো তাই ছাত্র সংসদের অস্তিত্বও না থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ কলেজে ছাত্র সংসদ যাদের দখলে ছিল, সেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) দৌরাত্ম্য বহু জায়গাতেই বহাল রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বার বার। প্রায়শই অভিযোগ ওঠে, কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। বহু ক্ষেত্রে বিপুল টাকা ব্যয়ে কলেজে-কলেজে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ এদের হাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নাকি টাকাও তুলে দেন বিস্তর। এই সমস্ত অভিযোগই ফের মাথা তুলছে কেকে-র মৃত্যুর পরে। প্রশ্ন উঠছে, কলেজ-ফেস্টে গান গাওয়ানোর জন্য মুম্বই থেকে নামী শিল্পী আনার রেস্ত এল কোথা থেকে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কলেজের অধ্যক্ষ বুধবার জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হলেও, টিএমসিপির নেতা-কর্মীদের কলেজে নিত্য আনাগোনা। অভিযোগ, পড়ুয়াদের ভর্তি ও নাম নথিভুক্তির সময়ে এই সব নেতা-কর্মীরা টাকা তোলেন। এক অধ্যক্ষের নির্দিষ্ট অভিযোগ, কলেজ মেরামতির জন্য কাজ শুরু হলে, সেই ঠিকাদারের কাছ থেকে পর্যন্ত টাকা তোলা হয়। এ ভাবে ‘অফুরন্ত’ টাকার জোগানের ফলে কেকে-র মতো ‘স্টার’কে দিয়ে অনুষ্ঠান করানো এঁদের কাছে কোনও বড় বিষয় নয় বলেই অধ্যক্ষদের একাংশের অভিমত। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যে ছাত্র সংসদের অস্তিত্বই নেই, তার হাতে কর্তৃপক্ষ ফেস্ট করার টাকা দেয় কী করে?
মঙ্গলবার নজরুল মঞ্চে কেকে-র অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, গত দু’বছর কোভিডের কারণে কলেজগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়নি। তাই কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়ে পড়ুয়ারা যে ছাত্র ইউনিয়ন ফি অথবা উৎসব ফি দিয়েছেন, তা কলেজের তহবিলে জমা ছিল। তার পরিমাণ কম নয়। সেই টাকা দিয়েই কেকে-র অনুষ্ঠান হয়েছে। ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজের অনুষ্ঠানে সোমবার ওই নজরুল মঞ্চেই গান গেয়েছিলেন কেকে। পরপর দু’টি কলেজের অনুষ্ঠানে আসায় পারিশ্রমিক তুলনায় একটু কম দিতে হয়েছে বলেও তৃণাঙ্কুরের দাবি।
স্যর গুরুদাস মহাবিদ্যালয় আয়োজিত কেকে-র অনুষ্ঠান নিয়ে সমাজমাধ্যমে যে পোস্টার ঘুরে বেরিয়েছে, তাতে দেখা গিয়েছিল, অনুষ্ঠানের আয়োজক হিসেবে এই কলেজের ছাত্র সংসদ এবং টিএমসিপি ইউনিটের উল্লেখ রয়েছে। প্রশ্ন হল, যে ছাত্র সংসদের অস্তিত্বই নেই, তারা কী করে উদ্যোক্তা হতে পারে? প্রশ্ন উঠেছে, সেই ছাত্র সংসদকে এবং টিএমসিপির ইউনিটের হাতে কলেজ টাকা দিতে পারে কি না।
তৃণাঙ্কুরের বক্তব্য, প্রচারের জন্য অমন পোস্টার সমাজ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছিল। আসলে খাতায়-কলমে উদ্যোক্তা হলেন কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। সূত্রের খবর, এই অনুষ্ঠানে ছাত্র সংসদের যিনি বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক, সেই রাজেশ মণ্ডলকে কোনও ভাবে যুক্ত করা হয়নি। এ দিন রাজেশ বলেন, ‘‘ফেস্টের বিষয়ে কিছু জানি না। আমি মঙ্গলবার দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে গিয়েছিলাম। নজরুল মঞ্চে যাইনি।’’
কলেজ সূত্রের খবর, কেকে-র অনুষ্ঠানের তদারকিতে ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ মণিশঙ্কর রায় এবং টিএমসিপি ইউনিটের সভাপতি পঙ্কজ ঘোষ। পঙ্কজ আদতে এই কলেজের শিক্ষাকর্মী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘টাকা-পয়সার বিষয় নিয়ে বাইরে কথা বলতে চাই না। এটি কলেজের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যদি বেশি কিছু জানতে হয়, তা হলে অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’’ অধ্যক্ষকে বার বার ফোন এবং মেসেজ করেও অবশ্য কথা বলা যায়নি। শিক্ষা মহলের একাংশের আবার বক্তব্য, শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অনেক অধ্যক্ষ সচরাচর চটাতে খানিকটা ভয়ই পান।
কলেজের এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্র সাধারণত বিনামূল্যে পড়ুয়াদের দেওয়া হয়। অথচ মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানে মোটা টাকায় সেই প্রবেশপত্র বিক্রি হয়েছে বলেও অভিযোগ। অন্য কলেজের বহু ছাত্রছাত্রী মোটা টাকায় সেই প্রবেশপত্র কিনে অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছেন।
রাজ্যে এখন অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে রাস্তায় নেমে ছাত্র আন্দোলন চলছে। অভিযোগ, নামে-বেনামে টিএমসিপি নেতারা সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সামনেই পরীক্ষা। স্যর গুরুদাস মহাবিদ্যালয় এবং ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজ— দু’টিই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ। সেখানেও অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন চলছে। চূড়ান্ত সিমেস্টার পরীক্ষার ফর্ম ফিল-আপের নোটিস বেরিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হল ভরিয়ে কলেজ ফেস্ট করা গেল কী করে, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কটাক্ষ, ‘‘অফলাইন পরীক্ষায় আপত্তি, অথচ ফেস্টে হল ভরিয়ে মারকাটারি ভিড়!’’
এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, ‘‘দায়িত্বজ্ঞানহীন টিএমসিপি নেতারা টাকা নয়ছয় করে এমন অনুষ্ঠান সংগঠিত করতে পারল কী করে?’’ তাঁর বক্তব্য, টিএমসিপির সর্বোচ্চ নেতারা তো সেখানে ছিলেন। তাঁরাই বা কী করছিলেন? চরম অগণতান্ত্রিক ভাবে কলেজ দখলে রেখে ছাত্রদের উৎসব করার মর্মান্তিক পরিণতি এখন দেখতে হচ্ছে বলে তাঁর দাবি।
ছাত্র সংগঠন ডিএসও-র রাজ্য সম্পাদক মণিশঙ্কর পট্টনায়ক অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নির্বাচিত নয় এমন ছাত্র সংসদগুলির যাবতীয় অপকর্মের দায় শাসক দলের ছাত্রনেতা এবং তাঁদের রাজনৈতিক অভিভাবকদের নিতে হবে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।