(বাঁ দিকে) মহুয়া মৈত্র। সীতারাম ইয়েচুরি (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
মহুয়া মৈত্র মামলায় লোকসভার এথিক্স কমিটির ‘অতি সক্রিয়তা’ নিয়ে সরব হলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও। মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তভার পেয়েই এথিক্স কমিটি যে ভাবে তৎপর, তা নিয়ে গত বুধবার মুখ খুলেছিলেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সোমবার ইয়েচুরি কার্যত মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বলেই এথিক্স কমিটির এত তৎপরতা।’’ একই বক্তব্য এর আগে শোনা গিয়েছিল লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর গলাতেও।
রবিবার সিপিএমের তিন দিনের কেন্দ্রীয় কমিটি বৈঠক শেষ হয়েছে দিল্লিতে। সোমবার দলীয় দফতরে সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন ইয়েচুরি। সেখানেই প্রশ্ন ওঠে মহুয়া এবং এথিক্স কমিটি নিয়ে। ইয়েচুরি বলেন, ‘‘কে কাকে কী উপহার দিয়েছেন, এই সংক্রান্ত বহু অভিযোগ এথিক্স কমিটির কাছে আছে। হঠাৎ করে একটি মামলার তদন্তে কেন তৎপর হল এথিক্স কমিটি? কারণ আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বাকিরা কি উপহার নেন না?’’ ইয়েচুরি দীর্ঘদিন রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। রাজ্যে বাম জমানায় বাংলা থেকেই সংসদের উচ্চকক্ষে একাধিক বার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। রাজ্যসভার এথিক্স কমিটিরও সদস্য ছিলেন এই সিপিএম নেতা।
মহুয়া প্রসঙ্গে ইয়েচুরির মন্তব্য নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিজেপি। বাংলায় বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ইয়েচুরি জোটধর্ম পালন করছেন। অপ্রাসঙ্গিক শক্তি সিপিএম এ ভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘রাজ্যে সিপিএম বলছে দিদি-মোদী বোঝাপড়া করছে। আর দিল্লিতে তৃণমূলকে সমর্থন করছেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক।’’
প্রসঙ্গত, ‘নিউজ ক্লিক’-এর সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং আধিকারিক অমিত চক্রবর্তীর গ্রেফতারির পর মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন মহুয়া। রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, প্রবীর সিপিএমের দলীয় সদস্য। কিন্তু মহুয়া কোনও সংকীর্ণতা দেখাননি। ইয়েচুরিও মহুয়ার ক্ষেত্রে কোনও ছুৎমার্গ রাখলেন না।
সরাসরি মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে এর আগে বক্তব্য রাখতে শোনা গিয়েছে কংগ্রেস বা আরজেডির মতো দলকে। মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ২০ অক্টোবর অধীর আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমি মনে করি না মহুয়া মৈত্র কোনও ভুল করেছেন। সাংসদ প্রশ্ন তুলবেনই। কিন্তু অপছন্দের প্রশ্ন হলে তাঁর মুখ বন্ধ করা হবে এটা কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হতে পারে না।’’ কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদের পাশে দাঁড়িয়ে বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ আরও বলেন, ‘‘কোনও সরকারের উচিত নয় কোনও একজন বা দু’জন শিল্পপতির পাশে দাঁড়ানো।’’
গত বুধবার সেলিমও প্রায় এক সুরে বলেছিলেন, ‘‘এখন এত হইচই কেন? কারণ, আদানির নাম এসেছে তাই। আদানি, মোদী, গুজরাত সব এক জায়গায় এনে দাঁড় করানো হচ্ছে। আদানির নামে প্রশ্ন উঠলেই তড়িঘড়ি সব হয়। রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ হয়ে যায়। আর যে এথিক্স কমিটি নারদকাণ্ডের পর ১০ বছর ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে, রাতারাতি তারাই তদন্ত শুরু করে দিল! বেছে বেছে করা হচ্ছে।’’ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক এ-ও বলেছিলেন, ‘‘অভিযোগ দেখলেই বোঝা যায় এটা আদানি স্পনসর্ড! আমি তো চাই এ নিয়ে আমায় সংসদের প্রিভিলেজ (স্বাধিকার রক্ষা) কমিটি ডাকুক।’’
মহুয়ার বিরুদ্ধে টাকা এবং উপহারের বিনিময়ে লোকসভায় প্রশ্ন তোলার অভিযোগ একই সঙ্গে জমা পড়েছিল দু’জায়গায়। বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে অভিযোগ জানান, শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিশানা করে সংসদে প্রশ্ন করার জন্য শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে নগদ টাকা এবং দামি উপহার নিয়েছেন মহুয়া। এ নিয়ে তদন্তের দাবি তুলে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি দিয়েছিলেন নিশিকান্ত। তিনি আরও অভিযোগ করেন, সংসদের ওয়েবসাইটে লগ ইন করার জন্য নিজের কোড এবং পাসওয়ার্ড হীরানন্দানিকে দিয়ে দিয়েছেন মহুয়া। ওই ব্যবসায়ী দুবাইয়ে বসে তার ‘সুযোগ’ নিয়েছেন। একই অভিযোগ জানিয়ে সিবিআই প্রধানকে চিঠি লিখেছিলেন মহুয়ার প্রাক্তন ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয় অনন্ত দেহাদ্রাই। মহুয়া পাল্টা দাবি করেন, সমস্ত সাংসদের লগ ইন কোড এবং পাসওয়ার্ড কবে কোথা থেকে ব্যবহার হয়েছে তা প্রকাশ করা হোক। তা হলেই বোঝা যাবে, আরও কেউ ওই একই কাজ করেন কি না।
এথিক্স কমিটি ইতিমধ্যে নিশিকান্ত ও জয়কে ডেকে এক প্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। মহুয়াকে মঙ্গলবার হাজিরা দেওয়ার জন্য প্রথমে চিঠি দিয়েছিল এথিক্স কমিটি। কিন্তু সাংসদ চিঠি লিখে জানান, ৪ নভেম্বর তাঁর পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি রয়েছে। ৫ নভেম্বরের পর তিনি যে কোনও দিন যেতে পারেন। ফের এথিক্স কমিটি মহুয়াকে চিঠি দিয়ে ২ নভেম্বর হাজিরা দেওয়ার কথা বলেছে। মহুয়ার দল তৃণমূল এখনও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে ধীরে এবং দেখেবুঝে এগনোর নীতি নিয়েছে। বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে মহুয়াকেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। তদন্ত শেষ হলেই দল যা বলার বলবে বলে জানিয়েছিলেন রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। তবে মহুয়াকে ডাকার তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্য তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। কুণালের বক্তব্য ছিল, ‘‘এথিক্স কমিটির এত তাড়া কিসের?’’ সোমবার ইয়েচুরিও সেই প্রশ্নই তুলে দিলেন।