গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ ।
প্রশাসনের ‘দখলদার’ উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে নবান্ন সভাঘরে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে সকাল থেকেই রাজ্য জুড়ে দখলমুক্তি অভিযান অব্যাহত। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরেই কলকাতা থেকে কোচবিহার— সারা বাংলায় ফুটপাথ দখলমুক্ত করার অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সেই অভিযানের তৃতীয় দিন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভায় সরকারি জমি দখল করে তৈরি বেআইনি অস্থায়ী নির্মাণ সরাতে তৎপর হয়েছে প্রশাসন। এই নিয়ে কয়েক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন অস্থায়ী ব্যবসায়ীরা। রামপুরহাটে ধস্তাধস্তি হয়। বৃহস্পতিবার খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্রেও ‘সাফাই’ অভিযানে নেমেছে পুলিশ। যদুবাবুর বাজারে গিয়ে স্থায়ী-অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেন পুলিশ আধিকারিকেরা। ব্যবসায়ীরা যাতে কোনও মতেই দোকানের জিনিসপত্র ফুটপাথে না রাখেন, সেই সংক্রান্ত নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রশাসনের তরফে দখলমুক্তি অভিযান শুরু হয়েছে মঙ্গলবার থেকে। তার আগে সোমবার নবান্ন সভাঘরে পুরসভাগুলির চেয়ারম্যান, পুরনিগমগুলির মেয়র এবং প্রশাসনিক আধিকারিকদের ডেকে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। জানান, বিভিন্ন পুরসভার পরিষেবা নিয়ে তিনি রুষ্ট। সরকারি জমি বেদখল হয়ে যাওয়া নিয়েও তীব্র ক্ষোভপ্রকাশ করেন তিনি। রাজ্যের কোন পুরসভা ভাল কাজ করেছে এবং কোন পুরসভার কাজে খামতি থেকেছে, তা নিয়েও কথা বলেন। এর পর থেকেই তৎপর হয় পুরসভাগুলি। মুখ্যমন্ত্রীর ধমকের পর সোমবার থেকেই পদক্ষেপ করা শুরু হয়েছিল কোথাও কোথাও। মঙ্গলবার সকাল থেকে তৎপরতা আরও বাড়ে। বুধবারেও একই তৎপরতা লক্ষ করা গিয়েছিল। এর পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকেও বেআইনি ভাবে সরকারি জমি এবং ফুটপাথ ‘দখলদার’দের সরিয়ে দিতে পদক্ষেপ শুরু করেছে প্রশাসন। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কোথায় দখলমুক্তি অভিযান নিয়ে কী পদক্ষেপ করল প্রশাসন—
কলকাতা পুরসভা: বৃহস্পতিবার সকালে আলিপুরে, চিড়িয়াখানার কাছে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী দোকান বুলডোজ়ার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। যদুবাবুর বাজারে নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান না হলেও পুরসভা এবং পুলিশের তরফে মাইকের মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে ব্যবসায়ীদের ফুটপাথ ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। ঘটনাচক্রে, এই দু’টি জায়গাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরের অন্তর্গত। বুধবার বিকেল থেকেই আলিপুর চিড়িয়াখানার সামনে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী দোকান ভেঙে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত এই অভিযান চলে। যদুবাবুর বাজারে দেখা যায়, পুলিশ এক দোকানদারকে রাস্তা থেকে মালপত্র সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করছে।
রাজপুর-সোনারপুর পুরসভা: পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গড়িয়া ও সোনারপুর এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে প্রশাসন। গড়িয়া বাজার, কবি নজরুল মেট্রো ষ্টেশন এলাকায় জবরদখল করে রাখা জায়গাগুলি থেকে ‘দখলদার’দের সরানো হয়েছে। দখলমুক্ত করা হয়েছে ফুটপাথগুলিও। গড়িয়া থেকে এনএসসি বোস রোড ধরে মহামায়াতলা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। অন্য দিকে, সোনারপুর বাজার এলাকাতেও অভিযান শুরু করেছে প্রশাসন। উচ্ছেদ অভিযান সরেজমিনে খতিয়ে দেখেন রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার পুরপ্রধান পল্লব কুমার দাস। রয়েছে সোনারপুর এবং নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশও। পল্লব বলেন, ‘‘পুরো এলাকা পরিষ্কার করা হবে। যাতে মানুষের কোনও অসুবিধা না হয়, সে দিকে নজর দেওয়া হবে। যারা জোর করে সরকারি জমি দখল করেছিলেন, তাঁদের উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ প্রশাসনের এই পদক্ষেপে খুশি পথচলতি মানুষ। স্থায়ীয়দের একাংশের বক্তব্য, ‘দখলদার’দের সরানো হলে যাতায়াতের সুবিধা হবে। তবে যাঁরা ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা করছিলেন, তাঁরা প্রশাসনের এই অভিযানে সমস্যায় পড়েছেন। অনেকেই ২০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছিলেন। অনেকে আবার লকডাউনের সময় থেকে ফুটপাথে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁদের বক্তব্য, ফুটপাথে ব্যবসা করেই সংসার চালাচ্ছিলেন তাঁরা। এখন পেটে ভাত কী ভাবে জুটবে, তা নিয়েই এখন চিন্তা বেড়েছে তাঁদের।
কামারহাটি পুরসভা: মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরই বৃহস্পতিবার থেকে ডানলপে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করল প্রশাসন। বেআইনি ‘দখলদার’দের উচ্ছেদ করতে আগে থেকেই মাইকের মাধ্যমে প্রচার করেছিল প্রশাসন। এর পর বৃহস্পতিবার সকালে ডানলপ থেকে কামারহাটি বিটি রোডের ধারে দু’পাশে দখলমুক্তি অভিযান শুরু করে প্রশাসন। যদিও ‘দখলদার’ ব্যবসায়ীদের দাবি, দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর ধরে এ ভাবেই ব্যবসা চালাচ্ছেন তাঁরা। মাঝেমধ্যেই প্রশাসন তাঁদের তুলে দেয়। পরে আবার সুযোগ হলে তাঁরা অস্থাযী দোকান পেতে বসে পড়েন। স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, ‘‘পথচলতি মানুষদের অসুবিধা হয় জানি। তবুও পেটের দায়ে ব্যবসা করতে হয়। দিদির নির্দেশে উঠিয়ে দিচ্ছে। আবার দিদিই নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করে দেবেন।’’
রিষড়া পুরসভা: রিষড়া পুরসভা এলাকায় ফুটপাথ দখল করে থাকা দোকানগুলি সরিয়ে ফেলতে মাইক নিয়ে প্রচার প্রশাসনের। সরকারি জায়গা দখল করে থাকা অস্থায়ী দোকানদারদের সাত দিনের মধ্যে দোকান সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে দোকান না সরালে তা ভেঙে দেওয়া হবে বলেও প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার রিষড়া মৈত্রী পথ,স্টেশন রোড, আরবিসি রোড, এনএস রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাস্তার উপর থাকা অস্থায়ী নির্মাণের ছাউনি খুলে ফেলা হয়। রিষড়া পুরসভার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আপাতত প্রতিদিনই এই অভিযান চলবে।
পুরুলিয়া পুরসভা: মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশিকার তিন দিন পর বৃহস্পতিবার দখলমুক্তি অভিযানে নামল পুরুলিয়া পুরসভাও। পুরুলিয়ার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রামবাঁধ পুকুর ভরাট করা নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। বার বার অভিযোগ জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি বলে স্থানীয়দের দাবি। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতার বৈঠকের পরেই নড়েচড়ে বসল পুরসভা। বুধবারেই পুরুলিয়া পুরসভার প্রধান নবেন্দু মাহালি পুকুর ভরাটের অভিযোগে ২ জনের বিরুদ্ধে পুরুলিয়া সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযুক্তদের নাম মহম্মদ সোনু আলম ও সুপ্রকাশ সেন । তাঁরা পুরুলিয়া শহরের নডিহার রহিম দাদ খান লেনের বাসিন্দা। অভিযোগের ভিত্তিতে সোনু আলমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অন্য জন পলাতক।
রামপুরহাট পুরসভা: রামপুরহাট শহরে ফুটপাথে ‘দখলদার’ উচ্ছেদ অভিযান ঘিরে তুলকালাম শুরু হয় বৃহস্পতিবার সকালে। পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন রামপুরহাটের ১৭ এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের অস্থায়ী ব্যবসায়ীরা। দোকান ভেঙে দেওয়ায় কয়েক জন ব্যবসায়ী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁদের প্রশ্ন, কেন আগাম নোটিস দিয়ে দখলমুক্তি অভিযানে এল না পুলিশ? যদিও প্রশাসনের দাবি, বুধবারই ওই ব্যবসায়ীদের ওখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তার জন্য মাইক নিয়ে প্রচারও চালানো হয়। কিন্তু তাঁরা না সরার কারণেই এই পদক্ষেপ। বৃহস্পতিবারের এই দখলমুক্তি অভিযানে উপস্থিত ছিলেন রামপুরহাটের মহকুমা শাসক সৌরভ পাণ্ডে, পুরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন ভকত এবং রামপুরহাট থানার আইসি-সহ পুলিশবাহিনী।
বোলপুর পুরসভা: রামপুরহাট পুরসভার পাশাপাশি বৃহস্পতিবার বেআইনি ‘দখলদার’দের উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছে বোলপুর পুরসভাও। জেসিবি দিয়ে বোলপুর হাই স্কুল এবং শ্রীনিকেতন এলাকায় ফুটপাথ ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে পুরসভার তরফে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত রয়েছেন পুরসভার আধিকারিকেরা। রয়েছে বোলপুর থানার পুলিশও।
শিলিগুড়ি পুরনিগম: বুধবারের পর বৃহস্পতিবার আবার ‘দখলদার’ উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয় শিলিগুড়িতে। উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয় শহরের হাসপাতাল মোড় সংলগ্ন সফদর হাসমি চক থেকে। অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা সমস্ত স্থায়ী এবং অস্থায়ী নির্মাণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ভেঙে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি পুরনো ফুল এবং বইয়ের দোকান। অন্য দিকে, শেঠ শ্রীলাল মার্কেটে ফুটপাত দখল করে থাকা কয়েকটি স্থায়ী দোকান ভাঙা হয় পুরনিগমের পক্ষ থেকে। ফুটপাথের ব্যবসায়ীদের দাবি, পুরনিগমকে নিয়ম করে দোকান বাবদ টাকা দেওয়ার পরেও কোন নোটিস না দিয়েই দোকান ভাঙচুর করা হল। এ প্রসঙ্গে, ফুটপাত ব্যাবসায়ী মহম্মদ হোসেন বলেন, ‘‘বিগত চল্লিশ বছর ধরে ব্যাবসা করছি ৷ প্রতিদিন পুরনিগমের জঞ্জাল অপসারণ বিভাগ জঞ্জাল অপসারণের নামে টাকা নিয়ে যায়। এখানে কোন জঞ্জালই জমতে দিই না। তবুও সেই টাকাটা আমরা দিই ৷ এখন দেখি কী করা যায়।’’ পুরোনো বই বিক্রেতা আনোয়ার হোসেনের কথায়, ‘‘পড়াশোনা করেও চাকরি পাচ্ছে না মানুষ। কিছু করে তো খেতে হবে। পেট তো শুনবে না। আমার দোকান অনেক পুরনো। সেটা ভেঙে দিয়ে গেল।’’