(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মহম্মদ সেলিম এবং অধীর রঞ্জন চৌধুরী। — ফাইল চিত্র।
আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীকে রোখার জোটে ইতিমধ্যেই কংগ্রেস-আপ সম্পর্ক ‘কাঁটা’ হয়ে ফুটছে। এ বার জোটের পরে কি বাংলাও ‘কাঁটা’? পটনায় বিরোধী জোটের প্রথম বৈঠকের পর ১৫টি দল মিলে ঠিক করেছে, বিজেপিকে রুখতে হবে। শিমলায় দ্বিতীয় বৈঠকে জোট নিয়ে রাজ্যওয়াড়ি আলোচনা হতে পারে। কিন্তু দেশের অন্যত্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে জোট বা আসন সমঝোতা হলেও বাংলায় কি তৃণমূলের সঙ্গে এক টেবিলে বসা সম্ভব সিপিএম বা কংগ্রেসের পক্ষে? বিশেষত, যে ভাবে প্রতিনিয়ত কংগ্রেস এবং সিপিএম তৃণমূলকে আক্রমণ করে?
বাংলায় আগেই জোট বেঁধেছে সিপিএম-কংগ্রেস। পঞ্চায়েত ভোটেও জোটবদ্ধ লড়াই তাদের। বিজেপি প্রধান প্রতিপক্ষ হলেও বাম-কংগ্রেসের মূল লড়াই তৃণমূলের বিরুদ্ধেই।
বাংলার মতো সমস্যা রয়েছে দিল্লি এবং পঞ্জাবেও। দু’টি রাজ্যেই ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি (আপ) কি আদৌ সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে এক মঞ্চে উঠবে? আগামী দিনে আরও রাজ্যে শক্তি বাড়ানোর কথা বলছsন আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরীওয়াল। তিনি লোকসভা ভোটে বাংলায় প্রার্থী না-দিতে চাইলে অবাকই হতে হবে। তাদের কি কোনও ‘ইতিবাচক’ আসন ছাড়তে চাইবেন মমতা? সোমবারেও তিনি বলেছেন, দিল্লিতে ‘মহাজোট’ করেই ছাড়বেন। কিন্তু পাশাপাশিই বলেছেন, বাংলায় ‘মহাঘোঁট’ ভেঙে দেবেন! সমস্যা হল, দিল্লির মহাজোট এবং বাংলার মহাঘোঁটের কুশীলব একই— সিপিএম এবং কংগ্রেস।
এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য জোটকে অনেকেই ‘সোনার পাথরবাটি’ বলছেন। বিজেপি যখন একক শক্তি বাড়াতে পারেনি, তখন তারা জোট রাজনীতিতে ভরসা রেখেছিল। আবার কংগ্রেসের একক শক্তি কমতে শুরু করতেই তারা জোটের পথে হাঁটতে শুরু করেছিল। রাজ্য স্তরে এখনও বিজেপি কিছু আঞ্চলিক দলের উপরে নির্ভরশীল। জাতীয় ক্ষেত্রে ‘বাধ্যবাধকতা’ থেকে সেই জোট বজায় রাখে বিজেপি। প্রতি বারই লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে জোট গঠনের চেষ্টা হয়। কিন্তু সেই বিরোধী জোট সে ভাবে সফল হয় না। ২০১৪ সালেও হয়নি। হয়নি ২০১৯ সালেও।
তবে এ বার জোট কিছুটা হলেও হতে পারে বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে। অতীতেও যেমন হয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের জোট না হলেও উত্তরপ্রদেশে প্রয়াত মুলায়ম সিংহ যাদব সনিয়া এবং রাহুল গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেননি। আবার মুলায়ম ছাড়াও তাঁর পরিবারের আরও চার জনের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। ঘটনাচক্রে সপা ওই পাঁচটি এবং কংগ্রেস সেই দু’টি আসনেই শুধু জয় পেয়েছিল সে বার।
বাংলায় ভোটের আগে জোট হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই বলে মনে করেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। শুধু বাংলায় নয়, সেলিমের দাবি, জাতীয় ক্ষেত্রেও কোনও জোট বা ফ্রন্ট সম্ভব নয়! তাঁর কথায়, ‘‘জাতীয় স্তরে জোট হবে না। বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। সিপিএম আগেই বলেছে যে, গোটা দেশের নিরিখে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে কী ভাবে ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তোলা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। সেই রকম রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে হবে। সকলকে বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। কিন্তু তৃতীয় ফ্রন্ট করলে চলবে না। ভোট তিন ভাগ করা যাবে না। বিজেপি বিরোধী ভোট গোটা দেশে এক করতে হবে।’’
তবে সেলিম এমন বললেও বিজেপি পটনা বৈঠকে ছবি তুলে ধরে রাজনৈতিক আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, ‘‘রাজ্যে বাম-কংগ্রেসের কর্মীরা মার খাচ্ছেন, রক্ত ঝরাচ্ছেন আর পটনায় তাঁদের নেতারা তৃণমূলের সঙ্গে বসে বিরিয়ানি-কফি খাচ্ছেন! বোঝাই যাচ্ছে সেটিং কেমন! আসল লড়াইটা শুধু বিজেপি লড়ছে।’’
প্রশ্ন অন্যত্রও। বামবিরোধী রাজনীতি করেই যাঁর উত্থান, সেই মমতা কি সিপিএমের সঙ্গে জোট গড়তে চাইবেন? সোমবারেও মমতা কোচবিহারে যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে তিনি সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপিকে একই বন্ধনীতে ফেলে আক্রমণ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে মমতা সিপিএমের সঙ্গে জোট গড়বেন, এমন কোনও সম্ভাবনা দুরূহ। বস্তুত, মমতার দলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় বলেই দিয়েছেন, ‘‘২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাংলা থেকে কংগ্রেস মাত্র দু’টি আসনে জিতেছিল। সিপিএম একটিতেও জেতেনি। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে দু’টি দলই শূন্য। ওই হিসেব মাথায় রাখলে আপাতদৃষ্টিতে এ রাজ্যে আগামী লোকসভা ভোটে কংগ্রেস এবং সিপিএমের একটিও আসনে লড়ার কথা নয়।’’ ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে যদি ‘একের বিরুদ্ধে এক’ তত্ত্ব মেনে জোট হয় তবে সিপিএমের চেয়েও খারাপ পরিণতি হবে কংগ্রেসের। আরও স্পষ্ট করে বললে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর।
অধীরের চিন্তা তাঁর সাংসদ পদ নিয়ে। যার জোরে তিনি লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা। অল্প ভোটে জেতা আবু হাসেম খানের মালদহ দক্ষিণ আসন চলে গেলেও বহরমপুরকে ‘হাত’-এর দখলে রাখতেই হবে। আশ্চর্য নয় যে, পটনার বৈঠক নিয়ে অধীর বলেছেন, ‘‘দেশ জুড়ে ‘ভারত তোড়ো’র নীতির বিরুদ্ধে ‘ভারত জোড়ো’র বার্তা নিয়ে কংগ্রেস নেমেছে বিজেপিকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে। পটনায় একটা বৈঠক হয়েছে। নীতীশ কুমার ডেকেছিলেন। তার সঙ্গে কংগ্রেসের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব জুড়ে দিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলে মুশকিল!’’ পটনায় বৈঠকের আগেই অধীর তাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘লক্ষ্মীপুজোর নেমন্তন্ন’ বলে। রবিবার বলেছেন, ‘বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন’ রক্ষা।
তবে বিজেপি জোরকদমে প্রচারে নেমে পড়েছে তিন দলের বিরুদ্ধে। বলছে, এরা একে অপরের ‘বি-টিম’। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘পটনায় কোনও জোটের বৈঠক হয়নি। ওখানে দশটি পরিবারের সঙ্গে পাঁচটি ছোট দল গিয়েছিল। মোদীজি পরিবারতন্ত্র শেষ করার যে লড়াই শুরু করেছেন তা থেকে বাঁচতেই গান্ধী, যাদব, বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সম্মিলন।’’
পঞ্চায়েত ভোটের মুখে এ সব শুনতে হচ্ছে পটনার বৈঠকে যোগ দেওয়া তিন দলকে। তবে সকলেই বলছে, তাদের কোনও ‘অস্বস্তি’ নেই। সেলিমের বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচন আর লোকসভা নির্বাচন এক নয়। দুটোকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এখানে লড়াই যেমন তৃণমূলের বিরুদ্ধে, তেমনই দিল্লিতে ঐক্যবদ্ধ লড়াই দরকার বিজেপির বিরুদ্ধে।’’ অধীর বলছেন, ‘‘মমতা এবং তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের লড়াই যেমন চলার তেমনই চলবে।’’ আর তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলছেন, ‘‘রাজ্যে বিজেপির দুই ভাই— সিপিএম এবং কংগ্রেস (আই)! পঞ্চায়েতেও ওরা বিজেপির সঙ্গে মিলেমিশে আছে। বিজেপির সঙ্গে লড়ছে তৃণমূলই।’’
তা হলে রাহুল কেন পটনায় গেলেন? কেনই বা শিমলায় যাবেন? অধীরের বক্তব্য, ‘‘না গেলে বলা হত, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে কংগ্রেস আন্তরিক বা দায়িত্বশীল নয়!’’ সিপিএম এবং তৃণমূলও কি সেই বাধ্যবাধকতা থেকেই পটনায় গিয়েছিল? জোট-টোট নয়, আসল দায় ‘আন্তরিকতা’র প্রমাণ দেওয়া। জোট ভাঙার দায় আর কে নিতে চায়!