ঘাটালের খড়িগেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। পড়ুয়া না থাকায় মাস খানেক আগে বন্ধ হয়েছে এই স্কুল। নিজস্ব চিত্র।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা
শিক্ষায় এমন বেহাল দশা কি এর আগে কখনও রাজ্যে হয়েছে?
প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী শ্রীঘরে, সঙ্গে তাঁর সঙ্গী অধিকাংশ শিক্ষা দফতরের প্রাক্তন কর্তারা। নিয়োগে দুর্নীতির ধাক্কায় শিক্ষক তো বটেই, গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি কর্মীদেরও চাকরি যাচ্ছে। অন্য দিকে, বোর্ডের পরীক্ষায় গত বছরগুলির থেকে কমছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, যা স্কুলছুটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই শিক্ষাবিদদের ধারণা। তাঁদের একাংশ এ-ও বলছেন, সরকারি এবং সরকার পোষিত স্কুলগুলির এই দশায় ক্ষয় ধরছে গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থায়। আর পড়ুয়াদের অভিভাবকেরা সাধ্যমতো বেসরকারি স্কুল বেছে নিতে শুরু করেছেন। ফলে গাঁ-গঞ্জেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর ঝোঁক বাড়ছে।
গ্রামাঞ্চলে পড়ুয়া কমার এই ছবিটা আরও প্রকট হয়েছে এ বারের মাধ্যমিকে। আগের তুলনায় এ বারে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো কম। পশ্চিম মেদিনীপুরে যেমন গত বছরের তুলনায় এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কমেছে ২১,২৭৫ জন। মুর্শিদাবাদে গত বারের থেকে ৩৬,৮৩৬ জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কম। তেমনই ৫,৬৪৯ জন মাদ্রাসা পরীক্ষার্থী কমেছে। এ বার যারা উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে, অতিমারির সময়ে তারা তো মাধ্যমিকে বসেইনি। দ্বাদশেই প্রথম বোর্ডের পরীক্ষা দিচ্ছে তারা। এই সব স্তরে রয়েছে শিক্ষকের অভাবও।
সহায়ক-সহায়িকা এবং সম্প্রসারক-সম্প্রসারিকা শেষ বার নিয়োগ হয়েছিল ২০১০ সালে। তখন থেকে অবসর-সহ নানা কারণে সেই সংখ্যা কমেছে। ফলে শিশুশিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলি শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। মুর্শিদাবাদে তো বেশ কিছু কেন্দ্রের ঝাঁপও পড়েছে। জানা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু প্রধান এই জেলায় এক সময় প্রায় ১৬০০ শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। তা এখন ১৪৭৮-এ এসে দাঁড়িয়েছে। শিশুশিক্ষা কেন্দ্র পিছু ৪ জন করে, সব মিলিয়ে জেলায় প্রায় ৬ হাজার সহায়ক-সহায়িকা থাকার কথা। সেখানে রয়েছেন মোটে ৪ হাজার জন। এই জেলায় মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রও আগের তুলনায় কমেছে। সেখানেও শিক্ষকের অভাব। অনেক জায়গায় একজন বা দু’জনকে কেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল এমএসকে-এসএসকে শিক্ষক সমিতির জেলা সভাপতি সামসুল হকও মানছেন, ‘‘শিক্ষকের অভাবে সঙ্কটে এমএসকে-এসএসকেগুলি।’’ হাওড়াতেও ১৬টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্ধকারে প্রায় ১৪ হাজার পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ।
শিক্ষা দফতরের অধীনে চলা প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় বা মাদ্রাসাগুলির অবস্থাও আগের থেকে করুণ। বিশেষ করে ‘উৎসশ্রী’র বদলি নীতিতে বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা নিজের পছন্দের স্কুলে চলে যাওয়ায় গ্রামীণ এলাকার স্কুলগুলিতে শিক্ষকের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেক স্কুলেই বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। কোথাও হাতে গোনা দু’তিন জন শিক্ষকের ভরসায় স্কুল চলছে। অপরিকল্পিত বদলি নীতির জেরে নদিয়া জেলায় কিছু এলাকায় ছাত্র আছে শিক্ষক নেই, কিছু ক্ষেত্রে আবার ছাত্র কম অথচ শিক্ষক প্রচুর। এই আবহে নদিয়ায় তালিকা প্রকাশ করে ২৫০টি প্রায় ছাত্রহীন স্কুলের ভবিষ্যতের সামনে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট ছাত্র না আসায় বর্ধমান শহরে গত এক বছরে ৭টি স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কুড়ির নীচে পড়ুয়া নিয়ে চলছে জেলার ৩৫০-রও বেশি প্রাথমিক স্কুল। পশ্চিম বর্ধমানে ১০১৩টি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে ৫৫টি পড়ুয়ার অভাবে সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। শান্তিনিকেতনের জেলা বীরভূমে ২০১১ সালের পরে সব মিলিয়ে ২৫৭টি ‘নিউ সেটআপ’ স্কুল চালু হয়েছিল। তার মধ্যে প্রায় ২৭টি শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) চন্দ্রশেখর জাউলিয়া বলছেন, ‘‘স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে শিক্ষা দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।’’ কম পড়ুয়ার জেরে বন্ধ হতে বসা বহু স্কুল রয়েছে পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামের মতো জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতেও। এখানকার জনজাতি পড়ুয়ারা মাতৃভাষায় শিক্ষাতেও বঞ্চিত বলে অভিযোগ রয়েছে। একাধিক সাঁওতালি মাধ্যম স্কুল চালু হয়েছে বটে, তবে সেখানেও সেই শিক্ষকের অভাব।
নিয়োগ দুর্নীতিতে বহু শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী চাকরি হারানোয় সঙ্কট ঘনীভূতই হয়েছে। বহু স্কুলে শিক্ষকদের এখন দরজা খোলা থেকে ঘণ্টা বাজানো— সবই করতে হচ্ছে। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরি বাতিলের তালিকায় বীরভূমে যেমন ৪৪ জন গ্রুপ-ডি কর্মী ও নবম-দশম শ্রেণির ৩৮ জন শিক্ষকের নাম ছিল। পশ্চিম বর্ধমানে সব স্তর মিলিয়ে সংখ্যাটা ৬৪, পূর্ব মেদিনীপুরে শতাধিক। দ্রুত নিয়োগ না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলেই শিক্ষক সংগঠনগুলির দাবি। অনেকেরই কটাক্ষ, স্কুলের মূল সমস্যা না মিটিয়ে নীল-সাদা ইউনিফর্ম তৈরিই জরুরি মনে করছে এই সরকার।