‘আসল’ সন্দীপ সাধুখাঁ (ছবিতে বাঁ দিকে)-র বাড়িতে ইডি আধিকারিকেরা। —ফাইল চিত্র।
১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির তদন্তে নেমে মঙ্গলবার সকাল থেকে জেলায় জেলায় তল্লাশি চালিয়েছে ইডি। সূত্রের খবর, আগেই এই দুর্নীতির বিষয়ে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থানায় দু’টি এবং হুগলির ধনেখালি থানায় একটি এফআইআর দায়ের হয়। তা ছাড়াও রাজ্যের অন্যান্য থানায় দু’টি এফআইআর দায়ের হয়। মোট পাঁচটি এফআইআর-এর ভিত্তিতে ইসিআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করে ইডি। প্রসঙ্গত, এই প্রথম এই বিষয়ের তদন্তে নামল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি। মঙ্গলবার সকালে ঝাড়গ্রাম, মুর্শিদাবাদের বহরমপুর, হুগলির চন্দননগর এবং সল্টলেকের একাধিক জায়গায় হানা দেয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি। তাতে অভিযুক্তদের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি, নথিও উদ্ধার করেন তাঁরা। তবে তল্লাশি চালাতে গিয়ে ইডিকে বিড়ম্বনার মধ্যেও পড়তে হয়েছে।
মঙ্গল-সকাল থেকেই জেলায় জেলায় ইডি
১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে এ বার নেমে পড়ল ইডিও। মঙ্গলবার সকাল থেকে চার জেলার একাধিক জায়গায় হানা দেন ইডি আধিকারিকরা। জিজ্ঞাসাবাদ করেন আধিকারিকদের। মঙ্গলবার সকালে জানা যায়, ঝাড়গ্রামের একটি সরকারি আবাসনে হানা দিয়েছেন ইডি আধিকারিকেরা। পরে জানা যায়, জেলার সংখ্যালঘু দফতরের এক আধিকারিককে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ইডি। মঙ্গলবার সকাল ৭টা নাগাদ ইডির ছ’জন আধিকারিকের একটি দল কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে হানা দেন ওই আধিকারিকের সরকারি আবাসনে। ঝাড়গ্রাম শহরের বাছুরডোবা এলাকার ওই আবাসন ঘিরে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। ঝাড়গ্রাম থানার পুলিশ খবর পেয়ে এলাকায় যায়। কিন্তু পুলিশকে আবাসনের ভিতর ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ইডি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, রাজ্যে ১০০ দিনের কাজে জাতিগত শংসাপত্র নিয়ে ‘দুর্নীতি’র বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে তারা। ঝাড়গ্রামের পাশাপাশি তল্লাশি চলে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এক বহিষ্কৃত পঞ্চায়েতকর্মী রথীন দের বাড়িতে। তল্লাশি চলে চুঁচুড়ার এক ব্যবসায়ীর বাড়িতেও। জানা গিয়েছে, ওই ব্যবসায়ীর নাম সন্দীপ সাধুখাঁ। তাঁর একটি লজেন্স কারখানা রয়েছে। যদিও পরে জানা যায়, যে সন্দীপের খোঁজ ইডি করছে, তিনি সেই সন্দীপ নন। ভুল সংশোধন করে ‘আসল’ সন্দীপের বাড়িতে যান ইডির গোয়েন্দারা। এ দিকে সল্টলেকের যে আবাসনে তল্লাশি চলে, সেটিতে ধনেখালির প্রাক্তন বিডিও এসকে পান থাকেন বলে ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে।
কেমো নিতে বেরোচ্ছিলেন, হঠাৎ ‘ভুল’ বাড়িতে ইডি!
মঙ্গলবার সকালে ইডির একটি দল পৌঁছয় হুগলির চুঁচুড়া স্টেশন সংলগ্ন ময়নাডাঙা এলাকায়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গে নিয়ে অপরিচিত কয়েক জন গাড়ি নিয়ে ঢোকার পর এলাকাবাসীর মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়। তার মধ্যেই ধুলো উড়িয়ে ইডির গাড়ি গিয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী সন্দীপ সাধুখাঁর বাড়ির সামনে। দরজায় টোকা দিয়ে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। প্রথমে চমকে যান পরিবারের সকলে। খানিক ক্ষণ পরে ভুল ভাঙে ইডির। আধিকারিকেরা বুঝতে পারেন, তাঁরা ‘ভুল’ সন্দীপের বাড়িতে চলে এসেছেন। ভুল বুঝে এর পরেই গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যান ধনেখালির রাস্তায়। ময়নাডাঙার সন্দীপের একটি লজেন্সের কারখানা আছে পোলবার মহেশপুর এলাকায়। ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত সন্দীপের ওই কারখানা এখন ঢিমে তালে চলে। এক সময় ২১ জন কর্মচারী ছিলেন। বর্তমানে কাজ করেন মাত্র সাত জন। ইডির ভুল নিয়ে সন্দীপের ছেলে শুভদীপ সাধুখাঁ বলেন, ‘‘সকালে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ইডি আমাদের বাড়িতে আসে। অফিসাররা নিজেদের পরিচয়পত্র দেখান। আমার বাবার নাম জানতে চান। তিনি কী করেন জানতে চান। আমি জবাব দিই। কিন্তু বাবা তো অসুস্থ! আর আমার বাড়িতে ইডি আসার কারণ জানতে চাই। বেশ কিছু ক্ষণ পর ইডি অফিসাররা বললেন, তাঁদের ভুল হয়েছে। তার পর সোজা বেরিয়ে যান তাঁরা।’’ এক নিশ্বাসে ওই কথাগুলো বলার পর শুভদীপ অভিযোগের সুরে বলেন, ‘‘কিন্তু তত ক্ষণে তো বাড়ির সামনে ভিড় জমে গিয়েছে। লোকজন উৎসুক হয়ে জানতে চান কী হয়েছে। কত জনকে জবাব দেব! আমাদের তো একটা সামাজিক সম্মান আছে। সে কথা ইডি ভাবল না!’’
‘বাবা’র নাম শুনে স্বস্তিতে ইডি!
হুগলির সন্দীপকে খুঁজতে গিয়েই সকাল সকাল ঠোক্কর খেয়েছে ইডি। চন্দননগরের বদলে ময়নাডাঙার সন্দীপের বাড়িতে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। সেই ভুল শুধরে আসল সন্দীপের বাড়ি যেতে যেতে বেলা হয়েছে। এ বার ঠিক জায়গায় তো? নিশ্চিত হতে প্রথমেই সন্দীপের বাবার নাম জানতে চেয়েছে ইডি। কী ভাবে খোঁজ মিলল ‘আসল’ সন্দীপ সাধুখাঁর? পঞ্চায়েতকর্মী সন্দীপ সাধুখাঁকে খুঁজতে গিয়ে ব্যবসায়ী সন্দীপ সাধুখাঁর বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল ইডি। তাঁদের ভুল ভাঙে বাবার নাম জিজ্ঞাসা করে। তাই চন্দননগরের সন্দীপের বাড়িতে পা দিয়ে ইডির প্রথম প্রশ্নই ছিল, ‘‘বাবার নাম কী?’’
ময়নাডাঙার সন্দীপের বাবার নাম শচীন সাধুখাঁ। আর যাঁর বাড়িতে ১০০ দিনের কাজে ‘দুর্নীতি’র তদন্ত করতে ইডি বেরিয়েছে, সেই সন্দীপের বাবার নাম অমল সাধুখাঁ। তাঁরা চন্দননগরের বাসিন্দা। হরিদ্রা পঞ্চায়েতের ওই কর্মীর বাড়িতে পৌঁছে ইডি আধিকারিক প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন সন্দীপ সাধুখাঁর বাবার নাম কী? বাড়িতে সন্দীপ ছিলেন না। ছিলেন তাঁর স্ত্রী মৌসুমী সাধুখাঁ। তিনি শ্বশুরমশাইয়ের নাম বলতেই ইডির দুই আধিকারিকের মুখে হাসি খেলে যায়। ‘অমল সাধুখাঁ’ শোনার পর তাঁরা বুঝতে পারেন এ বার আর ভুল হয়নি। সেই বাড়িতে ঢোকে ইডি। ইডি যখন বাড়িতে, সন্দীপ তখন ছিলেন তাঁর কর্মস্থল খানাকুলের জগৎপুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে। ইডি আসার খবর পেয়ে সাইকেল নিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। তার আগে সন্দীপের স্ত্রী এবং মাকে একপ্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ করে নিয়েছে ইডি। তত ক্ষণে নথির খোঁজে তল্লাশিও শুরু হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, সাড়ে সাত ঘণ্টা তল্লাশি চালানোর পর সন্দীপের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ইডির গোয়েন্দারা। সন্দীপকে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি সিজিও কমপ্লেক্সে ইডির অফিসে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
১০০ দিনের টাকা ‘নয়ছয়’ মুর্শিদাবাদের দুই সরকারি কর্মীর?
১০০ দিনের কাজের টাকা নয়ছয় করার মামলা দায়ের হয়েছে মুর্শিদাবাদের দুই সরকারি কর্মীর বিরুদ্ধে। তাঁদের মধ্যে একজন প্রাক্তন পঞ্চায়েত কর্মী রথীন্দ্রনাথ দে এবং অন্য জন মুর্শিদাবাদ জেলার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের বর্তমান নোডাল অফিসার সঞ্চয়ন পান। সকাল ৭টা নাগাদ বহরমপুর বিষ্টুপুর কালীবাড়ির কাছে প্রথমে যে বাড়িতে ইডি আধিকারিকেরা টোকা মারেন সেটি প্রাক্তন পঞ্চায়েত কর্মী রথীন্দ্রনাথ দের। দরজা খুলতেই নিজেদের পরিচয় দিয়ে একটি নোটিস ধরিয়ে দেন ইডি কর্তারা। পরে তাঁর বাড়িতে প্রায় জনা দশেক ইডি আধিকারিক প্রবেশ করেন। তারপর থেকেই শুরু হয় টানা জিজ্ঞাসাবাদ। সাত ঘণ্টা জেরা শেষে বেরিয়ে যান আধিকারিকরা। অন্য দিকে, রথীন্দ্রনাথের বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন সঞ্চয়ন। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার মনরেগার নোডাল অফিসার। ধনিয়াখালির বিডিও থাকাকালীন মনরেগায় ভুয়ো জব কার্ড তৈরি থেকে ভুয়ো অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেনের অভিযোগ ওঠে ওই আধিকারিকের বিরুদ্ধে। মামলাও হয়। সেই মামলার তদন্তে নেমে মঙ্গলবার সঞ্চয়নকে জেরা করেন ইডি কর্তারা। তবে তাঁকে বহরমপুরেই পাওয়া যাবে কি না সেই নিশ্চয়তা না থাকায় সঞ্চয়নের সল্টলেকের আবাসনের দুটি ফ্ল্যাটেও একই দিনে যান ইডি আধিকারিকরা। শেষ পর্যন্ত বহরমপুরে মধুপুরে তাঁর ভাড়া বাড়িতে তাঁকে টানা সাত ঘণ্টা জেরা করা হয় বলে সূত্রের দাবি। কিছু নথিপত্র প্রিন্ট করার প্রয়োজন হওয়ায় এক সময় তাঁর বাড়িতে বাইরে থেকে একটি প্রিন্টার নিয়ে আসতেও দেখা যায় ইডির গোয়েন্দাদের। তবে জেলা প্রশাসনের ওই কর্তা ইডি আধিকারিকরা বেরিয়ে যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দাবি করেন, “ইডির নিশ্চয়ই কিছু জিজ্ঞাসাবাদ ছিল। সে সব আমার কাছ থেকে ইডি কর্তারা জানতে চেয়েছিলেন। আমি সব কিছু বলেছি। সহযোগিতা করেছি।” তবে কী বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি তা অবশ্য জানাতে চাননি এই আধিকারিক। তবে এ দিন জেলা প্রশাসনিক ভবনের দুই কার্যালয়েই তিনি যাননি বলে প্রশাসন সূত্রে খবর।
১০০ দিনের টাকায় বান্ধবীকে ১৭ লক্ষ!
মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার আগে রথীন্দ্রকুমার দের গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলেছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। বহরমপুরের বহিষ্কৃত পঞ্চায়েতকর্মীর বাড়িতে কড়া নেড়ে ঢোকার পর চলে টানা জিজ্ঞাসাবাদ। ইডির নজর রথীনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। তাঁর কাছ থেকে কোথায় কত টাকা গিয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত এগোচ্ছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ‘রহস্যময়ী’র খোঁজ। সংশ্লিষ্ট মামলায় পঞ্চায়েতের প্রাক্তন কর্মী রথীনকে ‘বড় মাথা’ বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। অভিযোগ, ১০০ দিনের কাজের টাকা তিনি পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ‘ট্রান্সফার’ করিয়েছেন। ইডি সূত্রে খবর, ওই বহিষ্কৃত পঞ্চায়েতকর্মী এক মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৭ লক্ষের বেশি টাকা পাঠিয়েছিলেন। সেই মহিলার সঙ্গে তাঁর ঠিক কী সম্পর্ক, তা এখনও জানা যায়নি। তবে এ টুকু জানা যাচ্ছে যে, তিনি বহিষ্কৃত পঞ্চায়েতকর্মীর ‘অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ’।