দীপ। —নিজস্ব চিত্র।
‘মেরা ভোলা হ্যায় ভান্ডারি, করে নন্দী কি সওয়ারি, শম্ভুনাথ রে…’ পকেটের ফোনের রিংটোন অসময়ে বেজে ওঠে। মানে ঠিক যখন সে নিজের উচ্চতা ছাপিয়ে আকাশ ফুঁড়ে অতিকায় হয়ে উঠছে, তখন!
কোমর ছাপানো চুল কষে জটা পাকিয়ে, চার ফুট দশ ইঞ্চির পুঁচকে অবয়ব দেওয়ালির লক্ষ্মী, গণেশ বক্স প্যাকিংয়ে থইহারা। হাজিপুর না না চেন্নাইয়ের পার্টি এসে এখনই হাঁক দেবে, মাল রেডি তো! ডাইসে গড়া হিন্দুস্থানি লক্ষ্মী, গণেশ ট্রাকে বোঝাই হয়ে দূর দেশে পাড়ি দেবে বাঙালির পুজো শুরুর আগেই। গলা পর্যন্ত কাজে ডুবে থাকার সময়েই বেআক্কেলে ফোনও ঠিক বেজে উঠবে।
কিংবা দড়ি টেনে প্যান্ডেলের ভিড় সামলাতে শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে ফেলার সময়েও ফোনের আদিখ্যেতা! দীপিকা দলুই.. দীপ…দীপকুমারের মনে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে গেল বার বেলঘরিয়ার পুজো-কত্তাদের গা-জ্বালানো খোঁটা! পঞ্চমী থেকে দশমী বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পুজোর ভিড় সামলানোর ডিউটি। তার পরেও শুনতে হয়েছিল, ‘ধুর ধুর তোর তো অত শর্ট হাইট, তুই আবার করলিটা কী!’ গম্ভীর মুখে দীপ বলে, “আপনাদের বিবেক বলে কিছু থাকলে আমার টাকাটা দিয়ে দেবেন!” দিয়েছিল। তবে যা কথা হয়েছিল ততটা নয়। ৬০০ টাকা রোজের ১০০ করে কেটে নেয় ওরা। দীপের ইচ্ছে করছিল, টাকাটা মুখে ছুড়ে মারি! কিন্তু ওইটুকুই বা কে দেয়! নিজের শরীরকে অতিক্রম করে ছিনিয়ে আনা রোজগার, সর্বস্বের মতো মুঠোয় আঁকড়ে ধরেছিল।
পুজো মানে আসলে নিজের শরীরটাকে জয় করারই লড়াই! মহালয়ার আগে পর্যন্ত দক্ষিণদাঁড়ির পালপাড়ায় লক্ষ্মী-গণেশের কাজ। সেটা ২৫০ টাকা রোজ। পুজোর ‘সিকুরিটি গার্ডের’ রেট আরও ভাল। তাই জিনসের নতুন ‘জামাপ্যানে’ সেজে হাতিবাগানে ঠাকুর দেখা, দল বেঁধে হাসি-মজাক এ সব জিন্দগি থেকে ঘুচে গেছে! এ বার দ্বিগুণ উৎসাহে কল্যাণীর পুজোয় ঝাঁপিয়ে পড়েছে দীপ। কখনও শক্ত হাতে দড়ি ধরে ভিড়ের ঢেউটাকে থামিয়ে দিতে হবে। বাকি সময় গলার শিরা ফুলিয়ে চিল্লিয়ে ভিড়টাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। শরীরে তার ডবল, মুষকো লোকজনকেও ঠেলে অক্লান্ত ভাবে ‘জলদি করুন, দাঁড়াবেন না, এগিয়ে চলুন’ বলে যেতে হয়!
দীপ জানে সব লোকের সমান মন নয়। ঠেলাঠেলিতে যদি মাথার লম্বা চুলটা খুলে যায়? সুদীর্ঘ কেশদাম, কোমল শরীরটাকে নিজের শত্রু বলে মনে হয় ঘা-খাওয়া ‘পুরুষের’। দীপ বলে, “আমার ভয় করে না! হাতে লাঠি আছে! আমাদের পারমিশন আছে, আমি মেয়ে ভেবে কেউ অসভ্যতা করলে সটান চালিয়ে দেব!”
তবে অসহ্য লাগলেও মা-বাপের মুখ চেয়ে ও পাড়ার ঝুম্পা, গঙ্গাদের মতো চুলটা কেটে ফেলতে পারে না! ভাবলে হাসিও পায়, প্রথম বড় হওয়ার সময়ে সে সারা ক্ষণ ছেলেদের সঙ্গে খেলে কেন বলে মা রাগ করত! আর পাঁচটা মেয়ের মতো মেয়েদের সঙ্গেই থাকতে বলত। এখন ঠিক উল্টো! দীপ মেয়েদের সঙ্গে কথা বললেই মা রেগে কাঁই! ‘কী ভেবেছিস, আবার তুই একটা কেলেঙ্কারি বাঁধাবি দীপিকা!’
উল্টোডাঙার স্টেশনের নীচে ধোপার মাঠের বস্তির একখানা ঘরের ঠিকানা! কলকাতার ঝকঝকে মসৃণ ত্বকের নীচে কাটা দাগের মতো এ পাড়াটা। ঘরের ভেতর একটা নিচু সিলিং খাড়া করে দোতলায় শোয়ার ব্যবস্থা। রাতে মই বেয়ে ওঠে দীপ, মা, বাবা আর ছোট ভাই! বাবা ভাড়ার ড্রাইভার। মায়ের বাবুর-বাড়ি ঠিকে কাজ। ২৩ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ‘বড় ছেলে’ এখন রুজির জন্য ইতিউতি খেটে বেড়ায়। মা সব বুঝেও তাকে ছেলে বলে মানলে তো! বাবা তাও চুপচাপ। মা নাছোড়, জোর করে ছোট ভাইকে রাখি পরাতে বলবে! বস্তির হাসি… হাসিনা বলে একটি মেয়ের সঙ্গে ভালবাসা হয়েছিল দীপের। পাড়ায় জানাজানি হতে, দু’বাড়িতে তুমুল গোলমাল! এখন দীপ আর হাসি শুধু চুপিচুপি ফোনে কথা বলে।
মা বোঝায়, ‘ওরে এ সব তোর পাগলামি! পুজোয় একটা শাড়ি পর, তোর জন্য ভাল ছেলে দেখি।’ বারো ক্লাস পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চিপে চুড়িদার পরে তাও স্কুলে গেছে দীপ। একটুআধটু শাড়ি পরারও চেষ্টা করেছে। মায়ের কথা শুনে এক বার ভেবেওছিল, সত্যিই এ আমার পাগলামি! ছেলেদের সঙ্গে ভাবসাবের চেষ্টাও করে।
কিন্তু নিজেকে কে ফাঁকি দেবে! পুজোর ভিড় সামলানোর ফাঁকে ক্লান্তিতে টনটন করে জীবনের ক্ষত। তখন প্যান্ডেলের দুগ্গার মাথার উপরে শিবঠাকুরকে খোঁজে দীপ! ভোলেবাবা তুমি আর পার্বতী কি আলাদা? ফোনের ভিডিয়োয় দেখা অর্ধনারীশ্বর মূর্তির ছায়া পড়ে কোমল দুঃখী পুরুষের চোখে! শিবভক্ত দীপ মনে মনে বলে, তুমি তো সবার দুঃখ বোঝো! এক বার বোঝাও না আমার মা-টাকে! আমি কি ছেলে নই! আমি কিছুতেই বিয়ে করে একটা ছেলেকে সুখী করতেপারব না! আমায় একটু নিজের মতো বাঁচতে দিক!
বছর দেড়েক আগে পঞ্জাবে এক বার রূপান্তরকামী পুরুষদের ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় নাম লেখায় সে! ছোট্টখাট্টো ফাস্ট বোলার নিজের নাম রাখে দীপ। খাতায়-কলমে সে অবশ্য দীপিকা! পুজোমণ্ডপে গার্ডের কাজ করতে এসেও দীপ দেখেছে, সে একা নয়! পাড়ায় যেমন গঙ্গা, ঝুম্পা, এখানেও তাদের মতো অনেকেই! এদের নাকি বলে ট্রান্সম্যান, রূপান্তরকামী পুরুষ! রূপান্তরকামী মেয়েরা আলাদা। দীপরা নিজেদের ‘ভাই’ বলে ডাকে। পুজো কমিটি ন্যাচারাল মেয়েদের ঘরে বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেও দীপরা আলাদা থাকে। ট্রান্সভাইরা সব এক সঙ্গে। পুজো মানে রাতজাগা খাটুনি! আবার পুজো মানে নিজের ভাঙাচোরা জীবনের গুমোট ছাড়িয়ে মুক্তির বাতাস।
ভাইরা মিলে ফোনে, এ দেশের বিস্ময় পেশিবহুল ট্রান্সম্যান আরিয়ান পাশার ছবি দেখে! রোমহীন নরম গালে হাত বুলিয়ে দীপ ভাবে, হরমোন পাল্টাতে কত টাকা লাগবে! কলকাতার একটি সংস্থার উদ্যোগে সম্প্রতি নিজের দোকান খোলার আশায় ঋণের আর্জি পেশ করেছে দীপ। দীপ আর এক ট্রান্সভাই রকি মিলে ২৮ হাজার টাকায় মুদির দোকান শুরু করবে। ছাঁচে গড়া লক্ষ্মী-গণেশের কাজের পাশাপাশি কাঠামোয় ঠাকুর গড়া শেখাও তার স্বপ্ন। ঠাকুর রং করা, গয়না পরানো এখন দীপের কাছে জলভাত! দীপ ভাবে, এক দিন প্যান্ডেলের ঠাকুরের চক্ষুদানও ঠিক শিখে নেব! কিন্তু এই সমাজের চোখ কবে ফুটবে? ঘুমহারা উৎসব রজনীতে ঘুরপাক খায় অনন্ত জিজ্ঞাসা!
সকালে হা-ক্লান্ত শরীরে জিরোতে বসে ফোন হাতে দীপ দেখে, রাতে ‘মিসড কল’ দিয়েছিল হাসি। পুজো মানে গোপন প্রেমের স্পর্ধিত উড়াল। শারদ আকাশ চেনে প্রেমিক পুরুষের মায়াটান।