উত্তর কলকাতার আহিরীটোলায় মণ্ডপ দেখতে আসা অনেকেই মাস্কহীন। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
সাতসকালে কলকাতা ও হাওড়ার কয়েকটি ঘাটে নবপত্রিকা স্নানের ছবিটাই ভিড়ের বেপরোয়া মেজাজ বুঝিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশমাফিক যথাসম্ভব কম লোকজন এনে পুজোর আচার সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু কে আর সে-সবের তোয়াক্কা করে! বাজে কদমতলা ঘাটের বারোয়ারি পুজো বা বাগবাজার মায়ের ঘাটে পুরনো বাড়ির কলাবৌ স্নানের ছবিটায় অন্তত করোনা নিয়ে ভয়ডরের লেশমাত্র ছিল না। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে দ্বারকেশ্বরের ঘাট এবং লালবাঁধ, পোকাবাঁধের মতো বিভিন্ন জলাশয়েও কলাবৌ নিয়ে শোভাযাত্রায় ভিড় হয়েছিল প্রচুর।
মনে হচ্ছিল, বারোয়ারি পুজোর কলাবৌ চান যেন ভাসানের নাচেরই প্রতিরূপ। তার উপরে জড়ামড়ি করে দল বেঁধে ছবি তোলার হিড়িক। নিজস্বী-ঝোঁক কলকাতার বাগবাজারে বিভিন্ন বড়-বাড়ির সদস্যদের মধ্যেও। গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত হাঁটার সময় কারও মুখে মাস্ক বিশেষ দেখা যায়নি। সেটাই শুরু! তার পরে দিনভর খড়কুটোর মতো উড়েই গিয়েছে কোভিড সতর্কতার বিধি। কোথায় মাস্ক আর কোথায়ই বা দূরত্ব রক্ষার বালাই!
সপ্তমীতে কলকাতা, দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার পথে পথে শুধু মানুষের ঢল। সকাল থেকেই রোদ-ঝলমলে পরিবেশে দলে দলে লোকে পথে নেমেছে। ভিড়ের টক্কর আহিরীটোলা, শোভাবাজার বনাম মুদিয়ালি, বালিগঞ্জে। 'বুর্জ খলিফা' দেখতে থিকথিক করছে লেক টাউন আন্ডারপাস! কলকাতার পুরস্কার পাওয়া প্রতিমাগুলো দেখতেও ভিড় বেড়েছে উত্তরোত্তর।
রাজ্যে কোভিড সংক্রমণে এগিয়ে কলকাতাই। করোনার পরীক্ষা-পিছু সংক্রমণের হার বাড়ছে বলে চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞেরা আশঙ্কা প্রকাশ করলেও জনতার মধ্যে সতর্কতার ছাপ চোখে পড়েনি। এই অবস্থায় ছোটদের সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ছে। তবে গোলপার্কের ঠাকুর দেখার ভিড়ে মাস্কহীন দুই কিশোরের মা-বাবাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘বাচ্চা মানুষ, ওরা কি অত ক্ষণ একটানা মাস্ক পরে থাকতে পারে!’
পুজোর গেট, জনতার হাঁটার লাইনে বেদখল উত্তর কলকাতার টালা পার্কের তারাশঙ্কর সরণি। দেখা যাচ্ছে, বিশেষ অতিথিদের জন্য রাস্তার একটা দিক ছাড়া আছে। অন্য দিকটায় দর্শকের থিকথিকে ভিড়। হাই কোর্টের নির্দেশমাফিক মণ্ডপে না-ঢুকে ওই রাস্তা থেকেই ঠাকুর দেখার বন্দোবস্ত। কিন্তু পারস্পরিক দূরত্ব রক্ষার দফারফা তাতেও। একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন বড় ক্লাবের পুজোয়।
প্রচণ্ড গরম থাকায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ভিড় কম ছিল মালদহ, কোচবিহার, শিলিগুড়ি বা দুই দিনাজপুরে। কিন্তু তার পরেই ছবিটা বদলে যায়। ভিড় ঠেকাতে মালদহ শহরে বেলা ৩টে থেকে যান নিয়ন্ত্রণ শুরু করে পুলিশ। ড্রপগেট দিয়ে আটকে দেওয়া হয় শহরের অলিগলি। দক্ষিণ দিনাজপুরের সীমান্ত এলাকা হিলিতেও ভিড় উপচে পড়ে। সন্ধ্যা থেকে কয়েক গুণ ভিড় বাড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাস্কহীনদের ভিড়ে বিধিনিষেধ কার্যত শিকেয় উঠেছে। করোনার স্বাস্থ্যবিধি শিকেয় তুলে মহাসপ্তমীতে লাগামছাড়া ভিড় হয় মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন পুজোতেও।
উলুবেড়িয়া শহরেও অটো-টোটো বন্ধ করে ভিড় ঠেকানো যায়নি। কিছু মণ্ডপে বিধি ভেঙে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। হুগলির জিটি রোডেও অটো-টোটো বন্ধ ছিল। মাস্ক ছিল খুবই কম দর্শকের মুখে। অসচেতন ভিড় দেখা গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার নানা প্রান্তেও। বনগাঁ শহরের কয়েকটি পুজো মণ্ডপের মধ্যে ঢুকে পড়েন এক শ্রেণির দর্শক। দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবা, বাসন্তীতে তেমন ভিড় হয়নি। যদিও ক্যানিংয়ে ভিড় ছিল।
বিষ্ণুপুরের রাজদরবার এলাকায়, মৃন্ময়ী মন্দিরের পুজো দেখতেও ভিড় ছিল ব্যাপক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাস্ক বা দূরত্ব-বিধির বালাই ছিল না। পুরুলিয়ার নিতুড়িরা খনি অঞ্চলের পুজো দেখতেও ভালই ভিড় হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামেও বিধি-ভাঙা ভিড়ের ছবি। অনেক জায়গাতেই মণ্ডপ থেকে বিলি করা হয়েছে মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার। তবে সে-সব ঠাঁই পেয়েছে মূলত পকেটেই!
দুই বর্ধমানেও এক ছবি। ভিড় ছিল বীরভূমের জেলা সদর সিউড়ি, বোলপুর এবং রামপুরহাটে। রাজ্য কোভিড ম্যানেজমেন্টের পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার কো-অর্ডিনেটর সমরেন্দ্রকুমার বসুর আশঙ্কা, “করোনা নিয়ে বার বার সতর্ক করা হচ্ছে। তার পরেও হুঁশ না-ফিরলে, সংক্রমণ বাড়লে, তা রোখা মুশকিল হবে।”