রাজ্য কমিটির বৈঠকে সিপিএম নেতৃত্ব। —নিজস্ব চিত্র।
পার্টি কংগ্রেস হয়ে গিয়েছে সওয়া এক বছর আগে। জোট-জটিলতায় পড়ে সেই পার্টি কংগ্রেসের লাইন এখন আবার রাজ্য কমিটির কাছে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে সিপিএমকে! দলের রাজ্য নেতৃত্ব জেলার নেতাদের বোঝাচ্ছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতাই বাংলায় হচ্ছে না। শাসক দলের প্রতি সুর নরম করার কথাও আসছে না। বিজেপির প্রচারে যেন কেউ ‘বিভ্রান্ত’ না হন!
পটনায় বিরোধী শক্তির বৈঠকে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী এবং সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরিকে দেখার পরেই ওই তিন দলকে এক বন্ধনীতে ফেলে আক্রমণ শুরু করেছিল বিজেপি। বেঙ্গালুরুর বৈঠকে ‘ইন্ডিয়া’ নামে বিরোধী জোট আত্মপ্রকাশ করায় সেই প্রচারের ধার আরও বাড়িয়েছে তারা। পঞ্চায়েত ভোটে বামেদের নিচু তলার কর্মীরা শাসক তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন অথচ দু’দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জাতীয় স্তরে একজোট হচ্ছেন— এই প্রচারই চালাচ্ছে গেরুয়া শিবির। সিপিএম তথা বাম শিবিরের একাংশেও প্রশ্ন উঠছে, বাংলায় যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে হত্যা করার অভিযোগ তুলে বামেরা রাস্তায় নামছে, তাদের সঙ্গে নিয়েই আবার জাতীয় স্তরে গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াইয়ের কী অর্থ? সংসদ চত্বরে তৃণমূলের সৌগত রায়ের পাশে পোস্টার হাতে সিপিএম সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্যকে দেখার পরে প্রশ্ন এবং গুঞ্জন আরও জোরালো হয়েছে। সিপিএম সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতে দলের অন্দরে প্রশ্ন উঠতে পারে বুঝেই রাজ্য কমিটিতে আগাম ব্যাখ্যা দিয়ে রাখলেন রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
পঞ্চায়েত ভোট ও সাংগঠনিক বিষয়ের পর্যালোচনার লক্ষ্যে মঙ্গলবার থেকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে শুরু হয়েছে সিপিএমের দু’দিনের রাজ্য কমিটির বৈঠক। দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি অবশ্য এই বৈঠকে আসেননি। দলীয় সূত্রের খবর, বৈঠকের প্রারম্ভিক ভাষণেই সেলিম ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন, দেশের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো রক্ষা করতে বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করার ডাক দেওয়া হয়েছিল পার্টি কংগ্রেসে। পটনা ও বেঙ্গালুরুতে বিরোধী বৈঠকে গিয়ে সিপিএম সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে। কোনও নির্বাচনী জোটে তারা যাচ্ছে না। আর বাংলার ক্ষেত্রে বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সব শক্তিকে একজোট করার লক্ষ্যও বহাল রয়েছে। সেলিমের বার্তা, বিরোধী বৈঠকের প্রেক্ষিতে বিজেপি ‘বিভ্রান্তি’ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পার্টি লাইন মাথায় রেখে দলের কারও বিভ্রান্ত হওয়ার কারণ নেই।
গোড়াতেই সেলিম এই বার্তা দিয়ে দেওয়ার পরে প্রথম দিনের বৈঠকে তৃণমূলের সঙ্গে একত্রে বসা নিয়ে তেমন জোরালো ওঠেনি। প্রসঙ্গ তুলেছেন অল্প কয়েক জন। কেউ কেউ অপেক্ষা করছেন আগামী ৪ থেকে ৬ অগস্ট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের জন্য। তবে পরিস্থিতি যে ‘অস্বস্তিকর’, ঘরোয়া আলোচনায় তা অস্বীকার করছেন না জেলা ও রাজ্য নেতাদের একাংশ। দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘সাধারণ মানুষ তো আর পার্টি কংগ্রেসের লাইন মনে রেখে চলেন না! পঞ্চায়েত ভোটে এত লড়াইয়ের পরে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে যে, তা হলে কি আমরা জাতীয় স্বার্থে তৃণমূল সম্পর্কে নরম হচ্ছি?’’
দলেরই কেউ কেউ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদীর প্রথম সরকারের আমলে একটি ঘটনায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভূমিকার কথা। বিজেপি নেতা-নেত্রীদের ‘ভাষা-সন্ত্রাসে’র প্রতিবাদে সংসদ চত্বরে তৃণমূলের সঙ্গেই ধর্না-বিক্ষোভে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল সিপিএমের। আগের রাতে জানতে পেরে বুদ্ধবাবু দিল্লিতে ফোন করে বলেছিলেন, তৃণমূলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কু-কথার প্রতিবাদ অর্থহীন। এতে বাংলায় দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে ভুল বার্তা যাবে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছিলেন সেলিমেরা। লোকসভায় সেলিম তখন সাংসদ।
রাজ্য কমিটিতে পূর্ব বর্ধমান, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ-সহ বেশ কিছু জেলার প্রতিনিধিরা বলেছেন, পঞ্চায়েতে ‘সন্ত্রাস’ ও বিস্তর ‘জালিয়াতি’র মধ্যেও সিপিএমের ভোট বেড়েছে, বিজেপির কমেছে। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা অবশ্য মেনে নিয়েছে, বিজেপির চেয়ে তারা এখনও সাংগঠনিক ভাবে পিছিয়ে। তবে অন্যান্য নির্বাচনের মতো পঞ্চায়েত ভোটের পরে সংগঠনে ‘হতাশার মনোভাব’ নেই বলে দাবি করেছেন জেলার নেতৃত্ব।