WB Panchayat Election 2023

‘সাইকেল-টাকা পেলাম, কিন্তু পাশ করে কী পাব?’

রাজ্যে সরকারি প্রকল্পের ছড়াছড়ি। তার সুবিধা পান গ্রামের বহু মানুষ। সেই ছায়া কি পড়বে এ বারের গ্রামের ভোটে?

Advertisement

সৌমেন দত্ত

মেমারি শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩৩
Share:

আমাদপুরে গ্রামের প্রান্তে কাঁচা রাস্তা রয়েছে এখনও। —নিজস্ব চিত্র।

রাস্তার দু’পাশে বিস্তৃত খেত। কিছু জমিতে আমন ধানের বীজতলা তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছু জমি আরও কিছুটা বৃষ্টির অপেক্ষায়। খানিক দূরত্বের মধ্যে পরপর দু’টি হিমঘর। আর একটু এগোলেই জমজমাট মোড়। আমাদপুর গ্রাম।

Advertisement

পূর্ব বর্ধমানের মেমারি শহর থেকে কিলোমিটার তিনেক দূরে আমাদপুর। বর্ধিষ্ণু এই গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশচন্দ্র চৌধুরীর বাড়ি এখানে। গ্রামে হাজার সাতেক মানুষের বাস। বড় চাষি থেকে ব্যবসায়ী পরিবারের সংখ্যা বেশ কিছু। রয়েছে চাকরিজীবী পরিবারও। আমন ধান ও আলু, দু’টি মূল ফসল এই এলাকায়। সমবায় সমিতির বড় অফিস আছে গ্রামে।

গ্রামের ভিতরে আছে আমবাগানও। তেমনই এক বাগানে গাছের ছায়ায় বসেছিলেন সোমা বেসরা, অঞ্জলি বেসরারা। অন্যের জমি চুক্তিতে নিয়ে চাষ করেন ওঁরা। বলছিলেন, ‘‘আমরা চাষ করে দাম পাচ্ছি না। কিন্তু বাজারে কিনতে গেলে সেই ফসলেরই চড়া দাম!’’ সরকারি প্রকল্পের টাকা পান না? ওঁদের জবাব, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার পাচ্ছি। রূপশ্রীর টাকায় মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু একশো দিনের কাজ বন্ধ। সেটা পেলে সরকারের টাকায় এত ভরসা করতে হত না।’’

Advertisement

গ্রামের ভিতরের রাস্তাঘাট পাকা। তবে শেষ প্রান্তে কাঁসারিপাড়ায় একটি রাস্তার কিছুটা অংশ এখনও কাঁচা রয়ে গিয়েছে। এই পাড়ায় বেশ কিছু বাড়িও কাঁচা। সরকারি প্রকল্পে কয়েকটি বাড়ি পাকা হয়েছে। একটি বাড়ির সামনে বসেছিলেন জনা কয়েক মহিলা। দিনমজুরি করে সংসার চলে। বলছিলেন, ‘‘করোনার সময়ে আমাদের কারও কাজ ছিল না। রেশনের চাল, সরকারের ভাতাই তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল।’’

ওই পাড়ার কিছুটা আগে, রয়েছে একটি টেরাকোটার মন্দির। মন্দির লাগোয়া দোতলা বড় বাড়ি। ব্যবসায়ী এই পরিবারের গৃহকর্ত্রী লাভলি বন্দ্যোপাধ্যায়ও লক্ষ্মীর ভান্ডারের ৫০০ টাকা পান। কিন্তু তাঁর মতে, ‘‘এই টাকা দেওয়ার থেকে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা করলে বেশি ভাল হত।’’ অদূরেই এক ভাঙাচোরা বাড়িতে বাস বৃদ্ধা আরতি মোদকের। তিনিও বলেন: ‘‘পাঁচশো-হাজার টাকায় আজকাল আর কী হয়? দিচ্ছে, তাই নিচ্ছি। এর চেয়ে জিনিসপত্রের দাম কমলে সুবিধে হয়।’’

ভাতায় যে সবাই সন্তুষ্ট নন, মেনে নিচ্ছেন এলাকার এক তৃণমূল প্রার্থীর স্ত্রী। সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘সবার ঘরে টাকা ঢুকছে। সরকারি টাকা কেউ ফেরাচ্ছেন না। কিন্তু সবাই ভালবেসে নিচ্ছেন, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই।’’ তাঁর সংযোজন: ‘‘মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের অনেকেই মনে করেন, এই টাকায় শিল্প গড়লে বাড়ির ছেলেমেয়েদের চাকরি হত। হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়ন করলে বেসরকারি জায়গায় টাকা খসিয়ে চিকিৎসা করাতে হত না।’’

তবে ভিন্ন মতও আছে। গ্রামের বাজারতলায় মুদির দোকান মুনমুন দে-র পরিবারের। তাঁর কথায়, ‘‘টাকা পেলে কার না ভাল লাগে! কত উপকারও হয়।’’ বৃদ্ধা সন্ধ্যা নন্দীর স্বামী সরকারি চাকরি করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরে পেনশন পান সন্ধ্যা। তিনিও মনে করেন, ‘‘গরিব মানুষের অনেক উপকার হয়েছে। ব্যাঙ্ক, ডাকঘরে পেনশনের টাকা তুলতে গেলেই সেটা বুঝতে পারি।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘আগে গ্রামের যে অংশের মানুষজনকে ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে দেখা যেত না। এখন ভিড় দেখতে পাই।’’

গ্রামে ১২টি দুর্গাপুজো হয়। সরকারি অনুদান পায় সব কমিটি। গয়না ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ নন্দী তেমনই এক কমিটির সম্পাদক। তাঁর দাবি, ‘‘অনুদান না পেলে অনেক পুজো বন্ধ হয়ে যেত। সরকারি টাকা পাওয়ায় মানুষের উপরে চাঁদার ভার কমেছে। এলাকার কিছু লোক কাজও পাচ্ছে।”

গ্রামের সিপিএম প্রার্থী শমিত চক্রবর্তীর যদিও বক্তব্য, মানুষের আয় ক্রমশ কমছে, সেই ক্ষোভ এ বার ভোটবাক্সে পড়বে। আমাদপুর পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান সাধনা হাজরাকে এ বার টিকিট দেয়নি তৃণমূল। তাঁরও দাবি, ‘‘কর্মসংস্থান না হওয়ায় বাসিন্দাদের একাংশ যে অসন্তুষ্ট, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।’’

বৃষ্টিভেজা পিচ রাস্তা ধরে সবুজসাথী সাইকেলে স্কুলে চলেছে নীল-সাদা পোশাক পরা ছাত্রীরা। কেউ একাদশ শ্রেণির, কেউ দ্বাদশ। তাদেরই এক জনের প্রশ্ন, ‘‘কন্যাশ্রীর টাকা, সাইকেল পেয়েছি। উপকারও হয়েছে। কিন্তু পাশ করার পরে চাকরিকি পাব?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement