প্রতীকী ছবি।
চিকিৎসা যতটা না পেশা, তার থেকে একশো শতাংশেরও বেশি সেবা। রোগার্ত মানুষের সেবা। সেই লক্ষ্যেই এমবিবিএস পাঠের সূচনা থেকেই পড়ুয়াদের রোগীর সামনে নিয়ে যান শিক্ষক-চিকিৎসকেরা। উদ্দেশ্য: রোগীর প্রতি চিকিৎসকের আদর্শ মনোভাব, আচরণ তৈরি করা এবং গোড়াতেই রোগীর রোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে শুশ্রূষা করা। কিন্তু শপথ পরিবর্তনের উদ্যোগের মতো শিক্ষাদানের সেই পদ্ধতিও কি বদলে ফেলা হচ্ছে? সেবাব্রতের জায়গায় যোগশিক্ষা, একটি পরিবার দত্তক নেওয়ার মতো বিষয় বেশি গুরুত্ব পেতে চলেছে?
৭ ফেব্রুয়ারি স্নাতক স্তরের ডাক্তারি পড়ুয়াদের পাঠ্যক্রমের বিষয়ে সর্বভারতীয় স্তরে বৈঠকে বসে জাতীয় মেডিক্যাল কমিশন (এনএমসি)। তার পরেই হিপোক্রেটিক শপথ, না, চরক শপথ— প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। চিকিৎসক মহলের অভিযোগ, চিকিৎসা-শিক্ষার গৈরিকীকরণ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার অবশ্য বলছেন, ‘‘যাঁরা গৈরিকীকরণ বলছেন, তাঁরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষার বাইরে আসতে পারেননি এখনও। দেশ এখন ভারতীয় জ্ঞান-ব্যবস্থা নিয়ে এগোচ্ছে। সারা পৃথিবী যখন শূন্য, পাই জানত না, তখন এগুলো হয়েছে। একে স্বদেশীকরণ বলা উচিত।’’ কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুর বলেন, “অনেক চিকিৎসক এই বিষয়ে চিন্তিত। আন্তর্জাতিক মূল্যবোধ বা মান বিসর্জন না-দিয়ে আমি ভারতীয় শিক্ষায় ভারতীয় বিষয় ঢোকানোর পক্ষে। সারা বিশ্বে চিকিৎসকেরা যে-শপথবাক্য পড়েন, তার বদলে চরক শপথ না-নিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গেই এই শপথবাক্য পাঠ করা যাবে না কেন?”
শপথের মতো পাঠ্যক্রম নিয়েও নানা জল্পনা চলছে। গোড়াতেই রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, পড়ুয়ার আত্মবিশ্বাস বাড়ানো এবং রোগীর প্রতি তাঁর আচরণ ও মানবিকতার উপরে জোর দিতে উদ্যোগী হয়েছিল জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল। দু’বছর আগে চালু হয় ‘কম্পিটেন্সি বেস্ড মেডিক্যাল এডুকেশন’। সম্প্রতি এনএমসি-র আলোচনায় যে-সব প্রস্তাব উঠে এসেছে, তা ওই শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধাক্কা দিচ্ছে বলে চিকিৎসক শিবিরের অধিকাংশের অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য, ২০২২-এ ভর্তি হওয়া ডাক্তারি পড়ুয়াদের জন্য মূল লক্ষ্যের বাইরে কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন জানাচ্ছে, ‘কম্পিটেন্সি বেস্ড মেডিক্যাল এডুকেশন’-এ আর্লি-ক্লিনিক্যাল-এক্সপোজ়ার বা অ্যাটিটিউড-এথিক্স-কমিউনিকেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মডিউল ছিল। সেখানে পড়াশোনার শুরুতেই পড়ুয়া রোগীকে কাছ থেকে দেখে চিকিৎসা শুরু করতেন। প্রথমে কারও তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি শিখে পরে নিজেই হাতেকলমে কাজ শেখার সুযোগ পেতেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘গুরুত্বপূর্ণ মডিউল দু’টি তুলে দেওয়ায় হাতেকলমে শিক্ষার সুযোগ যেমন সঙ্কুচিত হবে, তেমনই রোগীর প্রতি এক জন চিকিৎসকের আচরণ, মনোভাব, সম্পর্ক স্থাপনের পদ্ধতি শেখা থেকেও বঞ্চিত হবেন পড়ুয়ারা।’’ এনএমসি-র প্রস্তাব, কোনও পড়ুয়া যে-কলেজে ভর্তি হবেন, তার আশপাশের বসতি থেকে একটি করে পরিবারকে দত্তক নিতে হবে। এমবিবিএস পড়াকালীন তাঁরা ওই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলবেন। তাতে পড়ুয়ার যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। কার কী রোগ হচ্ছে, কী চিকিৎসা হচ্ছে, তা-ও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবেন। সেই সমীক্ষা রিপোর্ট তিনি নথিভুক্ত করবেন। এই পদ্ধতিতে পড়ুয়া কতটা শিখবেন, চিকিৎসকেরা কিন্তু সেই ব্যাপারে সন্দিহান।
‘কম্পিটেন্সি বেস্ড মেডিক্যাল এডুকেশন’ পদ্ধতি পুরোপুরি রূপায়ণের আগেই তা বাতিল করে দেওয়ার বিরোধিতা করে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছেন মানসবাবুদের সংগঠন এবং অন্যেরাও। চিকিৎসক প্রশ্ন তুলছে শিবির যোগশিক্ষা নিয়েও। তাতে সূর্যপ্রণাম, প্রাণায়াম, ধ্যানের কথা বলা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বলে দাবি করেছেন কয়েক জন। তবে অধিকাংশের অভিযোগ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের উপরে যোগশিক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ১০ দিনে কাউকে যোগশিক্ষা দেওয়া যায় না। গেরুয়া শিবিরের অনুসারী হতে বাধ্য করানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ ‘এআইডিএসও’। চিকিৎসা শিক্ষা সর্বজনীন। তাই ইংরেজি ভাষাতেই তার পঠনপাঠন চলে। সেই জায়গায় নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠ নেওয়ার প্রস্তাব কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন চিকিৎসকেরা।