খাগড়াগড় কাণ্ডে ধৃত তিন অভিযুক্তকে সিআইডি হেফাজতে রেখে জেরা করতে চেয়েছিল এনআইএ। নবান্ন রাজি হয়নি। বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তের জন্য রাজ্য পুলিশের ৩০ জন কর্মী চেয়ে আবেদন করেছে ওই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। নবান্ন সাড়া দেবে এমন কোনও ইঙ্গিত নেই।
বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তভার এনআইএ-কে দেওয়া নিয়ে গোড়া থেকেই আপত্তি জানিয়েছিল রাজ্যের শাসক দল। সেই আপত্তি উড়িয়ে কেন্দ্র স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তাদের দায়িত্ব নেওয়ায় ফেসবুকে বিষোদ্গার করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। ফলে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের অনেকেই এনআইএ তদন্তের পক্ষপাতী হলেও সাহায্যের হাত বাড়ানো যাচ্ছে না তাদের দিকে।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রেই খবর, পশ্চিমবঙ্গে নিজস্ব স্থায়ী দফতর নেই বলে ধৃত রাজিয়া বিবি, আলিমা বিবি ও হাসপাতালে ভর্তি আব্দুল হাকিমকে সিআইডি-র হেফাজতে রেখে জেরা করতে চেয়েছিল এনআইএ। কিন্তু রাজি হয়নি রাজ্য। ফলে সল্টলেকে সিআরপিএফ-এর অতিথিশালায় অস্থায়ী লকআপ তৈরি করে রাজিয়া-আলিমাকে রাখতে হয়েছে।
তদন্তের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে সম্প্রতি নবান্নের কাছে অফিসার ও কর্মী স্তরের মোট ৩০ জন পুলিশ চেয়েছিল এনআইএ। সেই আবেদনও মানা হচ্ছে না বলে নবান্নের শীর্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে। তবে সরকারি ভাবে নবান্ন এখনও এ ব্যাপারে এনআইএ-কে কিছু জানায়নি।
কেন বাড়তি লোক চাইছে এনআইএ? কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটির কলকাতা শাখায় এখনও পর্যন্ত সব মিলিয়ে বিভিন্ন স্তরের ৮৬ জন অফিসারের পদ অনুমোদিত হলেও আপাতত স্থায়ী ভাবে কাজ করছেন ৮ জন। এর মধ্যেই বর্ধমান কাণ্ডের তদন্তভার হাতে এসে যাওয়ায় দিল্লি-সহ অন্যান্য রাজ্য থেকে অফিসারদের উড়িয়ে আনতে হয়েছে। কিন্তু জঙ্গি-জাল যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গ ও তার বাইরে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, তার তদন্ত হাতে গোনা কয়েক জনকে দিয়ে সম্ভব নয় বলেই মনে করছে এনআইএ। তাই তাদের আরও কিছু দক্ষ লোক প্রয়োজন। এবং সেই কারণেই রাজ্যের কাছে ২ জন ডিএসপি, ৪ জন ইনস্পেক্টর, ৮ জন সাব-ইনস্পেক্টর ও ১৬ জন কনস্টেবল চাইতে গত সপ্তাহেই নবান্নে গিয়ে প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন এনআইএ-র আইজি সঞ্জীব সিংহ।
কিন্তু রাজ্য সরকারের এক কর্তা জানাচ্ছেন, এনআইএ চাইলেও আপাতত পুলিশ দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর যুক্তি, “হাতে ভাল অফিসার নেই। তাই এনআইএ-র অনুরোধ রাখা সম্ভব হচ্ছে না।” সারদা তদন্তের শুরুতে সিবিআই-ও ডিএসপি-ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার ৩০ জন অফিসার চেয়েছিল। তাদেরও তা দেওয়া যায়নি।
গুরুত্ব বিচারে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সঙ্গে আর পাঁচটা তদন্তের যে তুলনা হয় না, গত কয়েক দিনে উঠে আসা তথ্যপ্রমাণই তা বলে দিচ্ছে। বিষয়টি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। নামতে হয়েছে এনএসজি-কে। তা-ও রাজ্যের এমন গয়ংগচ্ছ মনোভাব কেন? নবান্নের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, খোদ মুখ্যমন্ত্রী যেখানে বিরূপ, সেখানে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নেবে কে! বস্তুত, প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো তদন্তকারী সংস্থাকে বাড়তি সহায়তা দেওয়ার নিয়ে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
অথচ রাজ্য পুলিশের সহযোগিতা না পেলে এই ধরনের ঘটনার তদন্তে যে সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়, তা প্রথম দিনেই স্পষ্ট করেছে এনআইএ। এর কারণ এনআইএ-র তদন্তকারীরা ভিন রাজ্য থেকে আসেন। খাগড়াগড়ের তদন্তেই দিল্লি থেকে একটি দল এসেছে। তাদের পক্ষে রাজ্যের পরিস্থিতি, আটঘাট বোঝা সম্ভব নয়। খুঁটিনাটি খবর পেতে রাজ্য পুলিশের উপরে নির্ভর করতেই হবে তাদের। সেই কারণে বিস্ফোরণের পরের দিন, ৩ অক্টোবর এনআইএ-র দুই অফিসার ঘটনাস্থলে গিয়ে চূড়ান্ত অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও তদন্তকারী দলে সিআইডি এবং রাজ্য পুলিশকে রাখা হয়েছে। এমনকী, রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতের ক্ষেত্র বাড়াতে না-চেয়ে দিন তিনেক আগে দেওয়া প্রেস বিবৃতিতেও এনআইএ বলেছে, পুলিশ এবং সিআইডি-র কাছ থেকে তারা ‘সহযোগিতা’ পাচ্ছে।
প্রকাশ্যে না বললেও রাজ্য পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত নিয়ে নিজস্ব মহলে কিছুটা উষ্মা অবশ্য প্রকাশ করেছে এনআইএ। সংস্থা সূত্রে খবর, মূলত দু’টি বিষয় নিয়ে বিস্মিত তাদের তদন্তকারীরা। এক, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রথমেই কেন ইউএপিএ আইনের বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের করা হয়নি? দুই, বিস্ফোরণের পর জঙ্গিদের ডেরার সন্ধান পেয়েও রাজ্য পুলিশ তল্লাশি চালাতে তৎপর হয়নি কেন? কেন সন্দেহভাজনরা গা-ঢাকা দেওয়ার পরে সেখানে তল্লাশির কাজেও এনআইএ-কে নামতে হল?
এ ব্যাপারে প্রশাসনের কর্তাদের ব্যাখ্যা, বিস্ফোরণ হয়েছিল পুজোর মধ্যে। তার পরেই ছিল ঈদ। তাই ঈদ শেষের আগে এই নিয়ে তৎপর হতে জেলা প্রশাসনকে নবান্নের শীর্ষ স্তর থেকে নিষেধ করা হয়েছিল। সেই কারণেই জঙ্গি ডেরার খোঁজ পেয়েও তৎপর হয়নি পুলিশ। বর্ধমান মডিউলের আর কোনও জঙ্গিকেও ধরা যায়নি।