কাজল শেখ ও অনুব্রত মণ্ডল। নিজস্ব ছবি।
তৃণমূলের অন্দরে অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ ও বিরোধী দুই শিবিরের মধ্যে সংঘাত রাজ্য রাজনীতিতে বহু চর্চিত বিষয়। যার জেরে বহু বার উত্তপ্তও হয়েছে বীরভূম। সেই অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ার মাস ছ’য়েক পর এ বার একমঞ্চে দেখা গেল দুই শিবিরকে। গরু পাচার মামলায় দলের জেলা সভাপতির নাম জড়িয়ে তাঁকে ‘হেনস্থা’ করা হচ্ছে বলে দাবি তুলে তাদের সুর চড়াতেও দেখা গেল ওই মঞ্চ থেকে। তা থেকেই জল্পনা, তা হলে কি অনুব্রতের গ্রেফতারি জেলা তৃণমূলের জন্য ‘শাপে বর’ হল? দূরত্ব ঘুচিয়ে দুই শিবিরের আচমকা ‘কাছাকাছি চলে আসা’ দেখে দলের একাংশের অন্তত তেমনটাই মত।
জেলবন্দি অনুব্রতকে দিল্লি নিয়ে গিয়ে জেরা করতে চায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ই়ডি)। তা নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে কর্মিসভার ওই মঞ্চ থেকে বিজেপিকে নিশানা করেছেন বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ নেতা গদাধর হাজরা। শাসকদলের ওই নেতার হুঁশিয়ারি, অনুব্রত কষ্ট পেলে এলাকার বিজেপি কর্মীরাও সমান কষ্ট পাবেন! ঘটনাচক্রে, সেই মঞ্চেই হাজির ছিলেন বীরভূমে তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্য কাজল শেখ। জেলার রাজনীতিতে যিনি আবার ‘অনুব্রত-বিরোধী’ বলে পরিচিত।
রবিবার নানুরের কীর্ণাহার-১ অঞ্চলে বুথভিত্তিক কর্মিসভার আয়োজন করেছিল তৃণমূল। কল্লোল ভবনের সেই সভামঞ্চ থেকে গদাধর দাবি করেন, অনুব্রতকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। হুঁশিয়ারিও দেন, ‘‘অনুব্রত মণ্ডলের উপর যে ভাবে অত্যাচার হচ্ছে, তাতে আমরাও বীরভূমে বিজেপিকে ছেড়ে কথা বলব না। অনুব্রত কষ্ট পেলে বিজেপি কর্মীদেরও ওই ভাবেই কষ্ট দেব আমরা।’’
বিজেপি অবশ্য গদাধরের এমন মন্তব্যকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। গেরুয়া শিবিরের বক্তব্য, মানুষই এই সব হুমকির জবাব দেবেন। দলের জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহা বলেন, ‘‘তৃণমূলের কাজ হুমকি দেওয়া। এতে আমরা ভয় পাই না। আমরা গরু পাচারে অভিযুক্তও নই।। এই সবের উত্তর দেবেন মানুষ। আমরা এ সব নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নই।’’
জেলায় অনুব্রত ও কাজলের ‘বৈরিতা’ দীর্ঘ দিনের। গত বছর অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ার পরেও কাজলের সমাজমাধ্যমের পোস্ট ঘিরেও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল দলের অন্দরে। নেতা-কর্মীদের একাংশের দাবি, ওই সব পোস্ট অনুব্রতকে নিশানা করেই। যদিও কাজল বরাবর তা অস্বীকার করেছেন। নানুরে গদাধর এবং কাজলের মধ্যে সংঘাত নিয়েও এককালে বহু চর্চা হয়েছে জেলার রাজনীতিতে। ২০১১ সালে নানুর কেন্দ্রের বিধায়ক নির্বাচিত হলেও পরের নির্বাচনে কাজলের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরেই গদাধর সিপিএমের কাছে হেরে গিয়েছেন বলেই মনে করেছিলেন দলের একাংশ। সেই সংঘাতের আবহে জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে গদাধরের দূরত্ব তৈরি হয় এবং পরবর্তী কালে বিজেপিতেও যোগ দেন প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক। পরে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরেই অবশ্য জোড়াফুলে গদাধরের প্রত্যাবর্তন ঘটে। তার পর এই প্রথম বার গদাধর ও কাজলকে এক মঞ্চে দেখা গেল। যা অত্যন্ত ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেই মনে করছেন অনেকে।
সম্প্রতি বীরভূম সফরে এসে দলের কোর কমিটিতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে গিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বর্ধিত কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন কাজলও। তৃণমূলের একাংশের মত, অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে কাজলের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করেছে জেলায়। ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠেছেন নানুরের এই তৃণমূল নেতা। কাজল-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘স্বয়ং তৃণমূলনেত্রী কাজলদাকে কোর কমিটিতে নিয়ে এসেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এতে তাঁর দায়দায়িত্ব বেড়েছে। সকলকে যাতে এক সঙ্গে নিয়ে দলের সংগঠনকে চাঙ্গা করা যায়, কাজলদা সেই চেষ্টাই করছেন। আমরা যে সঠিক পথেই এগোচ্ছি, তা কাজল শেখ ও গদাধর হাজরার একমঞ্চে আসা থেকে বোঝা যাচ্ছে।’’
দলের অনেকে আবার ভিন্ন মতও পোষণ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, যেখানে কর্মিসভায় হয়েছে, সেই নানুর কাজলেরই এলাকা। সেখানে দুই শিবিরের একমঞ্চে আসা গোটা বীরভূমের নিরিখে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একটি ঘটনার সঙ্গে গোটা জেলাকে মিলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। তা হলে সেটাকে সরলীকরণ করা হবে।
তবে দলের স্বার্থে একমঞ্চে আসা যে জরুরি, তা অবশ্য কোনও পক্ষই অস্বীকার করছেন না। এক জেলা নেতা বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে দলের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই আমাদের নিজেদের মধ্যে যাবতীয় মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব দূরে সরাতে হবে। একজোট হয়ে কাজ করতে হবে।’’