গ্রেফতারের পর সেলিম।—নিজস্ব চিত্র।
পরনে ফর্মাল অফিস শার্ট। কাঁধে অফিস ব্যাগ। দেখলে নিপাট অফিসযাত্রী বলেই মনে করতে পারেন যে কেউ।
ট্রেনযাত্রীদের এই নিরীহ ভাবনাই ছিল সেলিমের ছিনতাইয়ের ইউএসপি। আপাত নিরীহ ভাবমূর্তিকে সঙ্গী করেই বিভিন্ন স্টেশন চত্বর থেকে লোকাল ট্রেনের কামরায় মহিলাদের গলা থেকে হার ছিনতাই করত সে। তবে এ কাজে তাকে সাহায্যের জন্য থাকত চার শাগরেদ। তবে হার নয়, রাস্তাঘাটে তাদের কথায় হার হয়ে যেত ‘সুতো’।
আর এভাবেই গত কয়েক বছরে সে ও তার সঙ্গীরা অনন্ত এক হাজার ‘সুতো’ ছিনতাই করেছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে বছর একত্রিশের সেলিম মণ্ডল। বুধবারও রোজকার মতো ‘চাকরিতে’ বেরিয়েছিল সেলিম। তবে একের পর এক অভিযোগ পেয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিল পুলিশ। এ বার আর শেষ রক্ষা হয়নি। এ দিন হাবরায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে তার দুই সঙ্গী। সেলিমের কাছ থেকে বেশ কিছু গাঁজা উদ্ধার হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সেলিমের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুর থানার বিড়া মেঠো পাড়া এলাকায়। তার আরও দুই সঙ্গী ধৃত রাম মণ্ডল ও রাজু মণ্ডল ওরফে সাইফুল ইসলামও দত্তপুকুরের বিড়া এলাকার বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার বারাসত আদালতে তোলা হলে ধৃতদের ১৪ দিনের জেল হাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।
হাবরা থানা সূত্রে জানানো হয়েছে, কিছু দিন আগে হাবরা স্টেশনের ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এক মহিলার সোনার হার ছিনতাই হয়। সেই ঘটনার তদন্তে নেমে সেলিমের নাম জানতে পারে তারা। এত দিন পুলিশ তার নামও জানত না। এ দিন গাঁজা পাচার করার সময়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে।
পুলিশের দাবি, জেরায় সেলিম জানিয়েছে, দত্তপুকুর থেকে রোজ সকালে শাগরেদদের নিয়ে বাসে করে নদিয়ার চাকদহে চলে আসত সে। তার পরে অফিস টাইমে সেখান থেকে কৃষ্ণনগর বা রানাঘাট লোকালে উঠে পড়ত তারা। বেশ ক’জন অফিসযাত্রীর সঙ্গে পরিচয়ও হয় তার। তবে কথা কম বলাতেই বিশ্বাস করত সে। শাগরেদরা লক্ষ্য রাখত, ট্রেনে কোন বৃদ্ধা বা মহিলা একা উঠেছেন। সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলে সেলিমকে জায়গা করে দিত তারা। এর পর ‘ফাইনাল অপারেশন’ চালাত সেলিম। মুহূর্তের মধ্যে কোনও মহিলার গলার হার নিপুণ দক্ষতায় টেনে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তার। বস্তুত, দীর্ঘ দিন এই ‘অপারেশন’ চালাতে চালাতে ট্রেনের ‘সুতো লাইনে’র (হার ছিনতাই চক্র) ‘মাস্টার’ হয়ে উঠেছিল সে। পুলিশের কাছে সে স্বীকার করেছে, এ ভাবে হাজার খানেক হার ছিনতাই করেছে সে। ধরা পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে শাগরেদরাই ‘মাস্টার’কে বেরনোর ব্যবস্থা করে দিত।
তবে ছিনতাইয়ের জিনিস নিজেরা ব্যবহার করা বা আত্মীয়দের ব্যবহার করতে দেওয়ায় অনীহা ছিল এই চক্রের। বরং ছিনতাই করা হার নৈহাটি-কৃষ্ণনগর এলাকার কিছু নির্দিষ্ট মহাজনের কাছে বিক্রি করত তারা। সেই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিত। তদন্তকারী অফিসারেরা জানিয়েছেন, ছিনতাই করা হার নিজেরা ব্যবহার করলে আবার অন্যদের তার জন্য টাকা দিতে হয়। তাই ঝামেলায় না গিয়ে বিক্রি করে টাকা ভাগাভাগি করে নিত তারা।
তবে এর আগে যে সেলিম একেবারেই ধরা পড়েনি, তা নয়। এক বার দমদমে ধরা পড়ে গণপিটুনি খাওয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। তবে পুলিশের কাছে এই প্রথম। পুলিশ জানিয়েছে, সম্প্রতি হাবরার একটি কাপড়ের কারখানায় ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে রাজু ও রামের বিরুদ্ধে।
সেলিমের অপরাধের ফিরিস্তি জানতে পেরে তাজ্জব পুলিশও। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “ হার ছিনতাইয়ে সেলিম খুবই দক্ষ। এমনটা আগে দেখিনি। আমরা রেলপুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করছি, এ রকম ছিনতাইয়ের ঘটনার সংখ্যা কত। সেগুলির সঙ্গে এই চক্রটি যুক্ত ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”