উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নেমেছে ধস নিজস্ব চিত্র।
তুমুল বৃষ্টিতে বেহাল উত্তরবঙ্গের পাহাড়। কার্যত একই পরিস্থিতি বহু দূরে থাকা উত্তরাখণ্ডের পাহাড়েও! বর্ষা শেষে প্রবল বর্ষণে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া পাহাড়ি জনপদ দেখে তাই অনেকেরই প্রশ্ন, এমন বিধ্বংসী দুর্যোগ কি হিমালয় পার্বত্য এলাকায় জলবায়ু বদলের প্রমাণ?
কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, শুধু জলবায়ু বদলই নয়, প্রকৃতিকে নষ্ট করে পাহাড়ি এলাকায় যে তথাকথিত উন্নয়নের যজ্ঞ চলছে, বিপর্যয়ের পিছনে তার অবদানও কম নয়।
এর মধ্যে একমাত্র আশার খবর, আজ, বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টি কমবে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের সিকিমের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক গোপীনাথ রাহা জানিয়েছেন, বিহারের উপরে থাকা নিম্নচাপটি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। তার ফলেই উত্তরবঙ্গে আবহাওয়ার উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। দক্ষিণবঙ্গেও আজ, বৃহস্পতিবার থেকে আবহাওয়ার উন্নতি হবে বলে হাওয়া অফিস সূত্রের খবর।
তবে আবহাওয়ার উন্নতি হলেও এমন বিপর্যয় নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। বস্তুত, উত্তরাখণ্ডেও কার্যত দিন দুয়েক বৃষ্টি হয়েছে। দার্জিলিং, সিকিম, কালিম্পঙেও তাই। কিন্তু সেই বৃষ্টির প্রাবল্য এতটাই বেশি যে বহু জায়গায় পথঘাট ধুয়ে গিয়েছে, নদী উপচে পথ ভাসিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় জোরালো বৃষ্টি যে অস্বাভাবিক তা বলা যায় না। এমনকি, অতি বর্ষণে দুর্যোগের উদাহরণও রয়েছে। এ বার দার্জিলিং-কালিম্পঙে প্রবল বৃষ্টি নিয়ে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথের ব্যাখ্যা, ঘূর্ণাবর্ত বা নিম্নচাপ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করলে গরম হাওয়া এবং পাহাড়ের শৈত্যের আন্তঃক্রিয়ার ফলে যে মেঘ তৈরি হয় তা থেকে এমন বৃষ্টি হয়। উঁচু পাহাড়ি এলাকায় কম উষ্ণতার ফলে মেঘের আয়তনও বড় হয়। এ বার দার্জিলিং, কালিম্পঙের মতো উঁচু পাহাড়ি এলাকাতেই বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
প্রবল বৃষ্টিতে জলের তলায় উত্তরাখণ্ড। ছবি পিটিআই।
তবে আবহবিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদদের একাংশের পর্যবেক্ষণ, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলাচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে কম বৃষ্টি হলেও অল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। তার ফলেই দুর্যোগ এবং বিপর্যয় বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ দফতরের তৈরি স্টেট অ্যাকশন প্ল্যান ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ রিপোর্টেও এই পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিপর্যয়ের পিছনে অবশ্য মানুষের অবদানও কম নয় বলে পরিবেশবিদদের দাবি। রাজ্যের এক নদী বিশেষজ্ঞের মতে, অল্প সময়ে এমন জোরালো বৃষ্টি দার্জিলিং, কালিম্পঙে সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায়নি। ষাটের দশকে এক বার অতিপ্রবল বৃষ্টির জেরে জলপাইগুড়িতে বিধ্বংসী বন্যা হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যতিক্রম। ওই বিশেষজ্ঞের মতে, তিস্তা নদীতে একের পর এক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। তার জেরে জল আটকে রাখা হচ্ছে। তার পর অতি বৃষ্টি হলে সেই জল এক সঙ্গে ছাড়া হচ্ছে। তা কার্যত তাণ্ডব নৃত্যের তালে নীচের দিকে নেমে এসেছে। এর পাশাপাশি যে ভাবে পাহাড়ে গাছ কেটে এবং পাথরের দেওয়াল ভেঙে উন্নয়নের কাজ হয়েছে, তার জেরে বিভিন্ন জায়গায় ধস নামছে বলেও তাঁর অভিমত।
উত্তরাখণ্ডের ক্ষেত্রে ২০১৩ থেকে বারবার এমন ঘটনা চোখে পড়েছে বলেও জানিয়েছেন ওই নদী বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে, জলবায়ু বদলের জেরে বৃষ্টির চরিত্র যেমন বদলাচ্ছে তাতে সচেতন না হলে আগামী দিনে বারবার এমন বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।