—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের জেরে গত কয়েক দিনে রাজ্য জুড়ে বৃষ্টির দাপট বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গির প্রকোপ। গত কয়েক দিনের ডেঙ্গির পরিসংখ্যান স্বাস্থ্যকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। রাজ্যের সমস্ত জেলাশাসক এবং জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম। ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষকেও সতর্ক থাকতে বলছেন চিকিৎসকেরা।
স্বাস্থ্যভবনের এক কর্তা জানান, রাজ্যে বর্তমানে দৈনিক ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ২৫০ থেকে ৩০০। এখনও পর্যন্ত মোট ৩০ হাজার মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বেসরকারি সূত্রে খবর, গত এক সপ্তাহে রাজ্যে ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়েছেন ৭,৬৭০ জন। তিনটি জেলার ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তিত স্বাস্থ্যভবন। উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদে মোট আটটি এলাকাকে ডেঙ্গি ‘হটস্পট’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যসচিব বলেন, ‘‘বৃষ্টিতে ডেঙ্গি আরও বাড়তে পারে। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাজ্যে ডেঙ্গি পরীক্ষার হার আগের চেয়ে বেড়েছে। এই মুহূর্তে ২০৮টি পরীক্ষাকেন্দ্রে ডেঙ্গি পরীক্ষা করা হচ্ছে। তিনটি জেলাকে নিয়ে চিন্তা রয়েছে। আবার, হাওড়া এবং হুগলিতে ডেঙ্গি সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে।’’ স্বাস্থ্য সচিব আরও জানান, ডেঙ্গি রোধে পঞ্চায়েত, পুরসভার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। কোথাও যাতে জল না জমে, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে। পরিচ্ছন্নতায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সকলকে মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ডেঙ্গি পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকেরাও। শহরের একাধিক হাসপাতালে ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে দোসর ম্যালেরিয়াও। সিএমআরআই হাসপাতালে এই মুহূর্তে ডেঙ্গি সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি রয়েছেন ৩৭ জন। এ ছাড়া, তিন জন ম্যালেরিয়া আক্রান্তও রয়েছেন। উডল্যান্ডস হাসপাতালে ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০। ম্যালেরিয়া নিয়ে ভর্তি আছেন এক জন। আমরি হাসপাতালে এই মুহূর্তে ডেঙ্গি নিয়ে ভর্তি আছেন ৮০ জন। তাঁদের মধ্যে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ১৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭ জন রোগীকে ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে আমরিতে ভর্তি করানো হয়েছে।
তিন জেলায় ‘হটস্পট’
ডেঙ্গি পরিস্থিতিতে রাজ্যের তিনটি জেলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগনায় হু হু করে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই তিন জেলার মোট আটটি জায়গাকে ডেঙ্গির ‘হটস্পট’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে— মুর্শিদাবাদের সুতি, লালগোলা, ভগবানগোলা ব্লক, নদিয়ার রানাঘাট, হরিণঘাটা ব্লক এবং উত্তর ২৪ পরগনার দক্ষিণ দমদম, বনগাঁ এবং বিধাননগর। অন্যান্য জেলার তুলনায় উত্তর ২৪ পরগনায় ডেঙ্গিতে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা বেশি। নদিয়ায় শুধু রানাঘাট, হরিণঘাটাতেই ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা হাজারের বেশি।
কোথায় কত আক্রান্ত
যে তিন জেলায় ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য মহল উদ্বিগ্ন, তার মধ্যে মুর্শিদাবাদে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা দু’হাজার ছাড়িয়েছে। বেসরকারি হিসাব বলছে, আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। নদিয়ায় মশাবাহিত এই রোগে ১৪৬১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। উত্তর ২৪ পরগনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৪০০ জন। স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবি, সরকারি পোর্টালে নথিবদ্ধ ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যার সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফারাক রয়েছে।
ডেঙ্গি বাড়লে সচেতনতা কমবে?
ডেঙ্গি বাড়তে শুরু করলে তা নিয়ে আতঙ্কের পরিবর্তে সচেতনতা কমে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, ‘‘বৃষ্টিতে ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই আরও বাড়বে। তাতে অন্য একটি সমস্যা হবে। অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে দেখলে মানুষের মধ্যে ডেঙ্গি নিয়ে সচেতনতা কমে যেতে পারে। জ্বর হলে অনেকেই হয়তো বেশি গুরুত্ব দিতে চাইবেন না। কিন্তু তাতে আরও বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা।’’
ডেঙ্গির দাপট কত দিন?
সিএমআরআই হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের চিকিৎসক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পুজো পর্যন্ত ডেঙ্গির দাপট চলতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘গত দু’সপ্তাহে ডেঙ্গি নিয়ে হাসপাতালে যাঁদের ভর্তি করা হয়েছে, তাঁদের অবস্থা তুলনামূলক বেশি গুরুতর। অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর মানুষ হাসপাতালে আসছেন। ডেঙ্গি সক্রিয়তার হারও আগের চেয়ে বেড়েছে।’’ ডেঙ্গির আঁতুড়ঘর জমা জল। তাই বাড়ির আশপাশে জল যাতে না জমে, তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
কী বলছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী বলেন, ‘‘এ বছর গ্রামীণ এলাকায় ডেঙ্গির প্রকোপ অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা ঠিক মতো হচ্ছে না। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁরা যখন হাসপাতালে আসছেন, তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে সমস্যা হচ্ছে চিকিৎসকদের। সে ক্ষেত্রে, মৃত্যু ঠেকানোও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’’ সিদ্ধার্থের পরামর্শ, চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সরাসরি হাসপাতালে যোগাযোগ করা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খেয়ে সময় নষ্ট না করাই ভাল। সিদ্ধার্থ আরও জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের পড়শি রাজ্যগুলির পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশেও ডেঙ্গি বেড়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় তাই বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। তবে বাকি জেলাগুলিতেও ডেঙ্গি পরিস্থিতিকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয় বারের ডেঙ্গি প্রাণঘাতী
আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক সায়ন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে বেশি অসুস্থতা নিয়ে ডেঙ্গি রোগীরা হাসপাতালে আসছেন। চিকিৎসার জন্য সময় তাই বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। ওই চিকিৎসকের কথায়, ‘‘দ্বিতীয় বার যাঁরা ডেঙ্গি আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনেক বেশি গুরুতর। মৃত্যুর সম্ভাবনাও এই দ্বিতীয় বারেই বেশি থাকছে। এক বার ডেঙ্গি আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে উঠলে শরীরে ডেঙ্গি-বিরোধী প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বার ডেঙ্গি আক্রান্ত হওয়ার অর্থ, সেই প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভেদ করে শরীরে বাসা বেঁধেছে ভাইরাস। এ ক্ষেত্রে তাই ডেঙ্গি বেশি প্রাণঘাতী।’’
কলকাতার ডেঙ্গি পরিস্থিতি
কলকাতার ডেঙ্গি পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। কলকাতা পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শহরে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ৩,৮০৩ জন। ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ২,৭৯০। এর মধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা ১,০১৩ বেড়ে গিয়েছে।
কী বলছেন মেয়র ফিরহাদ?
পুজোর আগে ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে কি না, সে বিষয়ে আশ্বাস দিতে পারেননি কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, ‘‘আমরা যতটা সম্ভব প্রস্তুতি নিচ্ছি। অন্যান্য শহরের তুলনায় এখনও কলকাতায় ডেঙ্গি অনেকটা কম। যে হেতু এখন আর লকডাউন নেই, করোনা নেই, মানুষের মুভমেন্ট রয়েছে, তাই ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়ছে। কোথায় মশা কামড়াচ্ছে, তা তো বলা মুশকিল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা প্রচার আরও বাড়াচ্ছি। মানুষ যাতে সচেতন হয়, সেই চেষ্টা করছি। এখন আমাদের লক্ষ্য এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ডেঙ্গি পরীক্ষা আরও বাড়িয়ে দেওয়া, ডেঙ্গি ধরা পড়লে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।’’
কলকাতায় ডেঙ্গিমৃত্যু
শনিবার কলকাতায় ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার বিজয়গড়ের বাসিন্দা ১২ বছরের ওই কিশোরীকে ডেঙ্গি সংক্রমণ নিয়ে এমআর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। মৃতের নাম ডোনা দাস।