মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
ঝকঝকে নিউটাউনের রাস্তার ধারে ঝুপড়ি দোকান দেখতে ভাল লাগছে না। আবার বুলডোজ়ার দিয়ে যে ভাবে দখলমুক্তির অভিযান চলছে, সেটাও ভাল লাগছে না দেখতে। উচ্ছেদ নিয়ে যখন আলোড়িত বাংলা, তখন বৃহস্পতিবার নবান্নের প্রশাসনিক বৈঠক থেকে ভারসাম্যের বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক দিকে, প্রশাসক হিসেবে পুলিশ এবং প্রশাসনকে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। পাশাপাশি, ‘দিদি’ হয়ে বলে দিলেন, ‘‘কারও পেটের ভাত কেড়ে নেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। কাউকে বেকার করে দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই।’’
গত সোমবার নবান্নে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই বৈঠক থেকেই ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। তার পর মঙ্গলবার থেকেই কলকাতা থেকে জেলায় জেলায় উচ্ছেদ অভিযানে নেমে পড়ে প্রশাসন। বুধবারও দিনভর সেই অভিযান চলেছে। সেই সব অভিযানের ফুটেজ ঘিরে রাজনৈতিক মহলে আলোচনাও শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ যেমন ‘বুলডোজ়ার বাবা’ হয়ে উঠেছেন, তেমন বাংলাতেও মমতা ‘বুলডো়জ়ার দিদি’ হয়ে উঠছেন। রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, সেই তুলনা মমতা বা তৃণমূলের জন্য মোটেই ইতিবাচক ছিল না। তা ছাড়া মমতার রাজনৈতিক ধরনের সঙ্গেও এই সিদ্ধান্ত খাপ খাচ্ছে না বলেই মত অনেকের। সেই প্রেক্ষাপটেই প্রশাসক এবং ‘মানবিক দিদি’— বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দ্বৈত ভূমিকায় দেখা গেল মমতাকে। মমতা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘‘বুলডোজ়ার দিয়ে দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া এখানকার সংস্কৃতি নয়।’’
মমতা এ-ও বলেছেন, ‘‘যাঁদের ফুটপাথে একটা ডালা নিয়ে বসার কথা, তাঁরা চারটে ডালা বসিয়ে দিচ্ছেন। সমস্যা সেখানেই হচ্ছে।’’ এ ব্যাপারে স্থানীয় কাউন্সিলরদের দিকেই ‘তোলাবাজির’ অভিযোগ করেছেন মমতা। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘হাতিবাগানে রাস্তা বলে আর কিছু নেই। এতে স্থানীয় কাউন্সিলরদেরই দায় রয়েছে। তাঁরা টাকা নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন। তার পর এখন বুলডোজ়ার গিয়ে উচ্ছেদ হচ্ছে। এটা করা যাবে না।’’ কাউন্সিলরদের উদ্দেশে মমতার প্রশ্ন, ‘‘এত লোভ কিসের? ভাত, ডাল, মাছ, তরকারি খেয়ে হচ্ছে না? আরও লাগবে?’’
উল্লেখ্য, জমি দখলের অভিযোগে বুধবার ডাবগ্রামের তৃণমূল নেতা দেবাশিস প্রামণিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সেই উদাহরণ দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘দেখেছেন তো, কালকে ডাবগ্রামের নেতাকে অ্যারেস্ট করিয়ে দিয়েছি। এ বার যে কাউন্সিলর করবে, তাকেও অ্যারেস্ট করিয়ে দেব।’’ পুলিশের একাংশও যে টাকা খাচ্ছে এবং দখলদারিতে মদত দিচ্ছে, সে কথাও প্রকাশ্যেই বলেছেন মমতা। তাঁর সোজা কথা, ‘‘অন্যায় করলেই গ্রেফতার করা হবে। ভাল কাজ করলে রাজ্য সরকার পুরস্কারও দেবে।’’
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম-সহ পুরসভার প্রথম সারির নেতাদের নিয়েও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন মমতা। বিভিন্ন হকার সংগঠনের লোকজন যখন বলছেন, তাঁরা কখনও মেয়র বা কখনও মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমারের সঙ্গে বসেছিলেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আরে ছাড়ুন ছাড়ুন। ওরা যদি বসে সব করেই ফেলতে পারত, তা হলে আমাকে বসতে হত না।’’ শুধু ফুটপাথ নয়, সামগ্রিক ভাবে জলাভূমি দখল নিয়েও ক্ষোভ জানিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘রোজই বিক্রমগড় থেকে শুনতে পাই, এই দখল হয়ে গেল, এই দখল হয়ে গেল। এটা কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি?’’
রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, মমতার মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিক জানেন, যে রোগ বাসা বেঁধেছে, তার মূলে রয়েছে স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশের একাংশের বোঝাপড়া। হাটের মাঝে সেটাকেই ভাঙতে চেয়েছেন মমতা। পাশাপাশি বার্তা দিয়েছেন, কোনও ভাবেই সরকার কাউকে ভাতে মারবে না। বিকল্প বন্দোবস্ত করার পথেই হাঁটবে নবান্ন।