চাকরির বাজারে ঘোর মন্দার মধ্যে ঠিক সময়ে পরীক্ষা আর ফলপ্রকাশ হলে লড়াই চালানোটা সহজ হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডব্লিউবিইউটি)-এ সেটা হচ্ছে না। তাই দুশ্চিন্তায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রায় ৩০০ কলেজের এক লক্ষ চল্লিশ হাজার পড়ুয়া। ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিয়োগের আগাম চিঠি পেয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা না-হওয়ায় চাকরির সুযোগ হারাতে চলেছেন তাঁরা।
রাজ্যে জুড়ে চাকরির খরা। সামান্য কয়েকটি শিল্প সংস্থা ‘প্লেসমেন্ট’ বা নিয়োগের সুযোগ নিয়ে আসে। সেখানে আবার পদের চেয়ে আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিতে ঠিক সময়ে পরীক্ষা হওয়াটা জরুরি। জরুরি যথাসময়ে ফলপ্রকাশও। কিন্তু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দু’টি ক্ষেত্রেই দেরি করায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন পড়ুয়ারা।
এই মুহূর্তে অবস্থাটা ঠিক কেমন?
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ডব্লিউবিইউটি-র অধীনে রয়েছে রাজ্যের প্রায় ৯৫টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এ ছাড়াও ম্যানেজমেন্ট, কারিগরি বিদ্যা, ফার্মাকোলজি পড়ানো হয়— এমন কলেজ আছে দু’শোরও বেশি। ওই সব কলেজে ২০১৪-’১৫ শিক্ষাবর্ষে বিবিএ, বিসিএ, এমসিএ, এমবিএ, এমটেক, বিটেক, বিফার্ম, বি-হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট, বি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের শেষ সেমেস্টারের পরীক্ষা শেষ হয়েছিল গত বছরের ৬ জুন। ফল বেরিয়েছিল ১৭ জুলাই। কিন্তু এ বছর এখনও পরীক্ষাই নেওয়া হয়নি। এ বার পরীক্ষা শুরু হবে ১৪ জুন। শেষ হবে ৭ জুলাই। কবে ফল বেরোবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তবে উপাচার্য সুব্রত দে-র আশ্বাস, পরীক্ষা যথাসময়েই শেষ হবে। ফলও প্রকাশ করা যাবে ঠিক সময়ে।
কিন্তু আগের বছরের নিরিখে এটা তো স্পষ্ট যে, এ বার পরীক্ষা শুরু হতে দেরি হচ্ছেই। কেন এই দেরি?
এই বিলম্বের জন্য নতুন উপাচার্যের কিছু সিদ্ধান্তকে দায়ী করে জল্পনা চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে যোগ দেন সুব্রতবাবু। এবং দায়িত্ব নিয়েই পরীক্ষা-পদ্ধতির আমূল সংস্কারে নেমে পড়েন। প্রশ্নপত্র ছাপানোর জন্য নতুন করে দরপত্র ডেকে নতুন সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, খাতা দেখা হবে কেন্দ্রীয় ভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ের সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। উপাচার্যের যুক্তি, এই সংস্কারে লাভবান হবেন পড়ুয়ারাই। কিন্তু সেই কর্মসূচি এমন সময়ে শুরু হয়েছে যে, তার জন্য গোটা পরীক্ষা প্রক্রিয়াটাই পিছিয়ে গিয়েছে। ‘‘ওঁর উদ্দেশ্যটা ভাল। কিন্তু হাতে সময় নিয়ে নামলে এই গোলমাল পাকাত না,’’ বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তা।
উপাচার্য অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন, ‘‘পরীক্ষা নিতে দেরি হওয়ায় যে-ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে দেওয়া হবে।’’
কী ভাবে?
উপাচার্য জানাচ্ছেন, প্রতি বছর পরীক্ষা শেষ হওয়া এবং খাতা দেখার মধ্যে এক সপ্তাহেরও বেশি ছুটি থাকে। এ বার সেই ছুটি কমিয়ে আনা হবে। পরীক্ষা শেষ হলেই শেষ বর্ষের খাতা পাঠিয়ে দেওয়া হবে শিক্ষকদের কাছে। তাঁরা যাতে দ্রুত খাতা দেখে জমা দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইদানীং যে-ভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে, তাতে উপাচার্যের আশ্বাস ভরসা দিতে পারছে না ছাত্রছাত্রীদের।
ভরসা রাখা যাচ্ছে না কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মের জন্য বিভিন্ন সুযোগ কী ভাবে তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা। বিটেকের এক পড়ুয়া জানান, গত বছর ১৭ জুলাই ফল বেরোনোর পরে দেখা গিয়েছিল, ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরির নিয়োগপত্র পাওয়া কয়েক জন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তাঁরা রিভিউয়ের আবেদন করেন। তাতে দেখা যায়, তাঁরা পাশ করেছেন। তত দিনে তাঁদের ওই চাকরির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। ওই পড়ুয়ার মন্তব্য, ‘‘এ বছর এত তাড়াহুড়ো করে খাতা দেখলে নম্বরের যে কী অবস্থা হবে, তা নিয়েই আশঙ্কায় আছি আমরা।’’
প়ড়ুয়াদের এমন আশঙ্কা সম্পর্কে উপাচার্য নিজেও অবহিত। তবে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘কোনও পড়ুয়ার কোনও রকম অসুবিধা হবে না।’’
উপাচার্য যা-ই বলুন, পরীক্ষা বিলম্বিত হওয়াটাই একমাত্র অসুবিধে নয়। সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য একটি ক্ষেত্রেও। ১৯ জুন, রবিবার ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট বা নেট রয়েছে। সে-দিন আবার পরীক্ষা রয়েছে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরও। অনেকে দু’টি পরীক্ষাতেই বসতে চান। প্রশ্ন উঠছে, যাঁরা নেট দিচ্ছেন, সেই সব প্রযুক্তি-পরীক্ষার্থীর কী হবে? কোন পরীক্ষাটাকে বলি দেবেন তাঁরা? কেনই বা দেবেন? ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ প্রসারিত করতেই তো একাধিক পরীক্ষায় বসা! কোনও পরীক্ষা ছেড়ে দিতে হলে তো সেই সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যাবে!! এই আশঙ্কা সত্ত্বেও নেটের নির্দিষ্ট দিনে (১৯ জুন) পরীক্ষা রাখা হল কেন?
‘‘ওই সময়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট বা আইআইএমেরও পরীক্ষা রয়েছে। আমাদের বেশির ভাগ পরীক্ষার্থী আইআইএম দেয়। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের রবিবারে পরীক্ষা রাখতে হয়েছে,’’ যুক্তি দেখাচ্ছেন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার রফিকুল ইসলাম।